জন্মদিনে স্মরণঃ সুবোধ ঘোষ
বাবলু ভট্টাচার্য : গত শতকের চল্লিশ দশকের প্রায় প্রারম্ভিক কাল ঘেঁষা বাংলা সাহিত্যের কাল পর্বের জীবন শিল্পী সুবোধ ঘোষ। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে একটু বেশি বয়সে যোগদান করেও নিজস্ব মেধা মনন চিন্তা চেতনা আর লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর অসাধারণ রচনা সম্ভারের মাধ্যমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন সুবোধ ঘোষ।
নানা টানাপড়েনের মাঝ থেকে উঠে এসেছে তাঁর লেখা। অসাধারণ রচনা সম্ভারের মাধ্যমে নিজেকে যেভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন তিনি, তা নিঃসন্দেহে নানা দিক দিয়ে চমকপ্রদ।
সুবোধ ঘোষের জন্ম বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে হলেও তিনি ছিলেন হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র। বিশিষ্ট দার্শনিক ও গবেষক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতেন তিনি।
প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব- এমনকি সামরিক বিদ্যায়ও তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। তাঁর লেখালেখির কালপর্ব ১৯৪০ থেকে ১৯৮০ সাল। তাঁর লেখা ‘অযান্ত্রিক’ এবং ‘ফসিল’ বাংলা সাহিত্যের যুগান্তকারী গল্প। ভাষার ওপর অনায়াস দক্ষতার প্রমাণ মেলে তাঁর বিভিন্ন স্বাদের গল্পে।
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করে হাজারিবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজে ভর্তি হয়েও অভাব অনটনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় তাঁকে। বিচিত্র জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁর জীবন। হেন কাজ নেই তাঁকে করতে হয়নি সংসারের ঘানি টানার প্রয়োজনে।
পড়াশোনা ছেড়ে কলেরা মহামারি আকার নিলে বস্তিতে টিকা দেওয়ার কাজ নেন। কর্মজীবন শুরু করেন বিহারের আদিবাসী অঞ্চলে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে। এ ছাড়া ট্রাক ড্রাইভার, সার্কাসের ক্লাউন, বোম্বাই পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণীর কাজ, চায়ের ব্যবসা, বেকারির ব্যবসা, মালগুদামের স্টোর কিপার ইত্যাদি কাজে তিনি তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেন।
বহু পথ ঘুরে অবশেষে ত্রিশ দশকের শেষে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হন। ক্রমে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক হন তিনি।
তাঁর একটি প্রখ্যাত ছোটগল্প ‘জতুগৃহ’। গল্পটি অবলম্বনে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তপন সিংহ ওই নামে একটি ছবি করেছিলেন এবং বোম্বেতে ‘ইজাজাত’ নামের একটি হিন্দি ছবি নির্মিত হয়, যেটি পরিচালনা করেছিলেন গুলজার।
অনামী সঙ্ঘ (বা চক্র) নামে তরুণ সাহিত্যিকদের বৈঠকে বন্ধুদের অনুরোধে সুবোধ ঘোষ ‘অযান্ত্রিক’ এবং ‘ফসিল’ নামে পর পর দুটি গল্প লেখেন যা বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সুবোধ ঘোষের আরেকটি বিখ্যাত গল্প ‘থির বিজুরি’। শুধু গল্পকার হিসেবেই সুবোধ ঘোষ অন্বেষু শিল্পী ছিলেন না। ছিলেন উপন্যাস রচনাতেও ঋদ্ধহস্ত। তার যথার্থ প্রমাণ ‘তিলাঞ্জলি’ (১৯৪৪)। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম প্রজ্ঞার স্বাক্ষর এই উপন্যাস। এতে তিনি উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন রাজনৈতিক মতাদর্শকে।
সুবোধ ঘোষের অপর উপন্যাস ‘গঙ্গোত্রী’ (১৯৪৭)-ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় রচিত। এ উপন্যাসে রাজনীতির বাইরের কথাও উঠে এসেছে। এক সময় তিনি ‘কালপুরুষ’ ছদ্মনামেও কিছু লেখা প্রকাশ করেছিলেন।
‘জতুগৃহ’, ‘ভারত প্রেমকথা’ (মহাভারতের গল্প অবলম্বনে রচিত), ‘গঙ্গোত্রী’, ‘ত্রিযামা’, ‘ভালোবাসার গল্প’, ‘শতকিয়া’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি-স্বরূপ সুবোধ ঘোষ লাভ করেন আনন্দ পুরস্কার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক।
১০ মার্চ, ১৯৮০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সুবোধ ঘোষ ১৯০৯ সালের আজকের দিনে (১৪ সেপ্টেম্বর) বিহারের হাজারিবাগে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment