জন্মদিনে স্মরণঃ জগজিৎ সিং
“তুমকো দেখা তো ইয়ে খয়াল আয়া,/ জিন্দেগি ধুপ তুম ঘনা সায়া। / তুম চলে যায়োগে তো সোচেঙ্গে, / হামনে কেয়া খোয়া, / হামনে কেয়া পায়া…”
বাবলু ভট্টাচার্য : গজল সঙ্গীতের প্রসঙ্গ আসলেই সবার আগে যার নামটি আমাদের মাথায় আসে, তিনি জগজিৎ সিং। গজলের দুনিয়ায় তিনি নিজেকে অবিস্মরণীয় উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যার ফলে এখনো তার গজলগুলো মানুষের একান্ত সময়ের সঙ্গী হয়ে আছে।
জগজিৎ সিং-এর জন্মগত নাম জগমোহন সিং। বাবা অমর সিং এবং মা বচন কাউরের ১১সন্তানের মধ্যে জগজিৎ ছিলেন তৃতীয়। তিনি শ্রী গঙ্গানগরের খালসা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রী অর্জন করেন৷ এরপর কলা বিভাগে ডিএভি কলেজ, জলন্ধর থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তিনি সঙ্গীতের সাথে যুক্ত ছিলেন শৈশবকাল থেকেই। গঙ্গানগরের পণ্ডিত চাগনলাল শর্ম্মা’র কাছে দু’বছর সঙ্গীতশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম ধারা- খেয়াল, ঠুমরী, ধ্রুপদ শেখেন উস্তাদ জামাল খানের ‘সাইনিয়া ঘরানা বিদ্যালয়’ থেকে।
১৯৬৫ সালে জগজিৎ গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে মুম্বাইয়ে চলে যান। শুরুতেই তাকে বিরূপ পরিবেশ ও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। প্রস্তুতি-পর্বে নিজেকে যোগ্যতা প্রমাণ ও যাচাইয়ের মুখোমুখিও হতে হয়েছে অনেকবার। সেজন্যে প্রয়োজনে তাকে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতে হয়েছে। এখানে তিনি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল ও পার্টিতে গান গাওয়া শুরু করেন।
তবে সাফল্যের শিখরে আরোহণের মাহেন্দ্রক্ষণে সিং দম্পতির জীবনের চরম শোকাবহ ঘটনাটি ঘটে। ১৯৯০ এর ২৮ জুলাই তাদের একমাত্র সন্তান বিবেক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই ঘটনা অনেকটাই স্থবির করে দেয় তাদের। এর ধারাবাহিকতায় চিত্রা সিং গানের জগতকে বিদায় জানান অর্থাৎ প্রকাশ্যে গান গাওয়া ত্যাগ করেন। তবে তার আগে পুত্রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত তাদের শেষ অ্যালবামটির (সামওয়ান সামহোয়ার) কাজ তারা শেষ করে নেন।
জগজিৎ সিং ছিলেন একাধারে গায়ক ও কম্পোজার। তার গানের ভক্তরা বলেন, তিনি গজল সঙ্গীতের জগতে একটি বিপ্লব এনেছিলেন এবং গজলকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
শুধু তিনি একা নন, তার স্ত্রী চিত্রা সিং ১৯৭০ ও ৮০’র দশকে গজলের জনপ্রিয় এক সঙ্গীত জুটি ছিলেন। সেসময় জগজিৎ সিংকে ‘গজল গানের রাজা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ভারতের ফিল্মি গানের ধারার বাইরে থেকেও তারা ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী।
‘অর্থ’ ও ‘সাথ সাথ’ সিনেমায় ব্যবহৃত তাদের গাওয়া গজলের সংকলন এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল তাদের সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবাম। লতা মুঙ্গেশকরের সঙ্গে তিনি প্রকাশ করেন ‘সাজদা’ (১৯৯১) অ্যালবামটি।
তিনি পাঞ্জাবি, হিন্দি, উর্দু, বাংলা, গুজরাটি, সিন্ধি ও নেপালি ভাষাতেও গান গেয়েছিলেন। প্রায় পাঁচ-দশকব্যাপী সঙ্গীত জীবনে তিনি ৮০টি অ্যালবাম প্রকাশ করেন। শুধু নিজের গানের মধ্যে থেমে থাকেননি তিনি।
শাস্ত্রীয় ও লোকশিল্পীদের নানাভাবে সাহায্য করতেন জগজিৎ। মুম্বাইয়ের সেন্ট মেরি স্কুলের লাইব্রেরি নির্মাণ, বোম্বে হাসপাতাল গঠন এবং ক্রাই, সেভ দ্য চিলড্রেন ও আলমা প্রভৃতি সংগঠনের কাজকর্মেও তিনি প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছেন।
‘হোঁটো সে ছুলো তুম’, ‘হোশ ওয়ালোকে খাবর কেয়া’, ‘কোই ফারিয়াদ’ কিংবা ‘হে রাম’ এর মতো তার অসংখ্য গজল মানুষের মনে আজো দোলা দেয়।
প্রেমের কবি মির্জা গালিবের কবিতাকে গানের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলায় ১৯৯৮ সালে তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতে অবদানের জন্য তাকে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত কারণে ভারতের মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালে ১০ অক্টোবর ২০১১ সালে মুম্বাইয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গজল সম্রাট। মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
জগজিৎ সিং ১৯৪১সালের আজকের দিনে (৮ ফেব্রুয়ারি) রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment