Press "Enter" to skip to content

গঙ্গা কিনারে বসে, নিভৃত দুপুরে পুলকের বুকের মধ্যে বাজত বাবার এস্রাজের ছড়ের সুর। প্রায় সকল সুরকার গায়ক ও গায়িকার অতি পছন্দের ছিলেন পুলক বন্দোপাধ্যায়…..

Spread the love

——–জন্মদিনে স্মরণঃ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়——

বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বাংলা ছায়াছবি যে বার সবাক হল, অর্থাৎ সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে দর্শক শুনল সুর, সেই বছরই বৈশাখি পূর্ণিমায় জন্ম হল এক গীতিকবির। তিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা, কান্তিভূষণ ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র। নির্বাক ছবির যুগের নায়ক। নিউ থিয়েটার্সের ছবি, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র নামভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। সেই সূত্রে বাড়িতে সিনে-দুনিয়ার নক্ষত্রদের আসা যাওয়া ছিল। নিত্য তাঁদের মজলিশ থেকে উড়ে আসত সেলুলয়েডের শব্দ-সুর-সংলাপ। আর সে সবই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরত পুলকের কানে। কাঁচা বয়সেই নিজের লেখা গান নিয়ে কোথায় না যাবার কথা ভেবেছেন পুলক! কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই প্রেম-বিরহের গান লিখে বাড়িতে বড়দের দেখানোরও সাহস পাননি তিনি। দেখালেন তুলনায় সহজ মানুষ, প্রযোজক জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়কে। ততদিনে সরোজবাবুর ‘অলকানন্দা’, ‘মনে ছিল আশা’ ছবি রিলিজ করে গিয়েছে। হাত দেবেন ‘অভিমান’ ছবিতে। শ্যালকের লেখা গান দেখে, তাঁকে ছবির সিচুয়েশন দিলেন।

পুলক লিখলেন সে গান। সুর করেছিলেন বম্বের ‘বন্ধন’, ‘পুনর্মিলন’ খ্যাত রামচন্দ্র পাল। যেদিন প্রথম দেখা হল সুরকারের সঙ্গে গীতিকারের, সেও এক বিড়ম্বনা! তার আগে তো কেউ কাউকে দেখেননি, পুলক গান পাঠিয়েছিলেন ডাকে। নলিনী সরকার স্ট্রিটে কলম্বিয়ার অফিসে ডেকে পাঠালেন গীতিকারকে। তার ঠিক ছ’ দিন বাদে পুলকের ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্ট। তবুও গেলেন।সে দিনের ঘটনার কথা লিখেছেন পুলক- ‘‘নাম বললাম। নাম শুনেই রামবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্ফুটে স্বগতোক্তি করে বলে ফেললেন, ‘এত ছোট বয়স… একে দিয়ে কী হবে!’’ সেই শুরু হল। গঙ্গা কিনারে বসে, নিভৃত দুপুরে পুলকের বুকের মধ্যে বাজত বাবার এস্রাজের ছড়ের সুর। কখনও নিজেই বসতেন চার্চ পিয়ানোতে। ক্রমে স্কটিশের ক্লাসঘর থেকে কবিতার শব্দেরা যেন ডানা মেলে উড়ে এসে বসতে লাগল তাঁর কলমে। বাংলা নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তেই কলকাতা বেতারে গীতিকারদের তালিকায় নাম উঠে গেল পুলকের! সে সময় রেডিয়োর অফিস গার্স্টিন প্লেস ছিল চাঁদের হাট। সখ্য হল অনেকের সঙ্গে। হাতে এল, দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সুরে প্রদীপকুমার অভিনীত ছবি ‘পলাতকা’-র কাজ। কলেজ পেরিয়ে পুলক যখন স্নাতকোত্তরের ছাত্র। একদিন ফের ডাক পেলেন গার্স্টিন প্লেসের বিমান ঘোষের কাছে থেকে। দোলের অনুষ্ঠানের জন্য গান লিখতে হবে। সুরকার অনুপম ঘটক! নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না পুলক! মান্না দে’র আধুনিক বাংলা গানের প্রথম গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার হলেও, পুলক ছিলেন তাঁর কাছে ‘ভার্সেটাইল গীতিকার’। পুলক তাঁর কাছে সংবেদনশীল, রোম্যান্টিক কবিও। সুরকার নচিকেতা ঘোষ গৌরীপ্রসন্ন ও পুলককে নিয়ে একটি প্রজেক্ট করেছিলেন। গেয়েছিলেন মান্না দে। গৌরী যখন লিখলেন, ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝোরো না গো অমন জোরে’, তার উত্তরে পুলক লেখেন, ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার’। আবার গৌরী লিখলেন, ‘যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে’। জবাবে পুলক লিখেছিলেন, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে।’

একদিন যেমন, নচিকেতা ফোন করে পুলককে বললেন, ‘‘ও পুলক, কোনও গান নেই। আমি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছি।… হয় এখনি এসো— না হয় টেলিফোনেই একটা গানের মুখড়া দাও।’’ যুতসই গানের কথা না পেলে টেলিফোনে এমনই কাতর হয়ে পড়তেন নচিবাবু।
সে সময় স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে তাঁর। হঠাৎ সেটা মনে পড়তেই পুলক টেলিফোনের ওপাশ থেকে বললেন, ‘‘লিখে নিন, দুটো লাইন। কাল-পরশুর মধ্যে গিয়ে বাকি গানটা শেষ করব। লিখুন, ‘ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে।’’’ ’৭১-এ সে-গানই গাইলেন মান্না!
‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’ আর ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’ এমন করেই লেখা। মান্না দে, পুলকের লেখা গান প্রথম প্লে-ব্যাক করেন ৬৫ সালে ‘দিনান্তের আলো’ ছবিতে। তার পর কত গান…!
একবার এয়ারপোর্ট থেকে মান্নাকে রিসিভ করে ফিরছেন পুলক। পথে মান্না একটি ঠুংরি গুনগুন করছিলেন। ঠুংরিটি কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে শেখা ‘শ্যাম, ঘুংঘট কে পট খোলো’। হঠাৎ পুলককে মান্না বললেন, ‘‘এইরকম একটা গান লিখুন তো মশাই।’’ পথে যেতে যেতেই গানের কথা এল পুলকের মনে। ততক্ষণে শ্যামবাজার…! পুলক বললেন, ‘‘গানটা এসে গেছে মশাই, নেমে পড়ুন, এখনই করে ফেলা যাক।’’ কাছেই গানের স্কুল বাণীচক্র। সেখানে গিয়ে একটি ঘর চেয়ে নিয়ে, হারমোনিয়াম আর খাতা পেন নিয়ে বসে পড়লেন দুই শিল্পী। জন্ম হল নতুন গানের- ‘ললিতা, ওকে আজ চলে যেতে বল না।’ ১৯৭০। ছবি ‘প্রথম কদম ফুল’। একটি গান-গাঁথার গল্পও খুব চমকপ্রদ। মান্না দে রান্না করতে ভালবাসতেন। একবার মুম্বইতে পুলক গিয়েছেন মান্নার বাড়ি। গিয়ে দেখলেন, রান্নাঘরে মান্না। অবাক পুলক। বললেন, ‘‘রান্না করছেন! কী রান্না?’’
‘‘তা তো বলব না আগে থেকে। আগে রান্না শেষ হোক। খেয়ে দেখুন। তারপর আপনাকেই বলতে হবে যে!’’ একটু পরে মান্না বসার ঘরে গিয়ে দেখলেন, পুলক একটা কাগজে লিখে ফেলেছেন বেশ কয়েকটা লাইন। মান্না বললেন, ‘‘কী ব্যাপার? কিছু লিখে ফেললেন নাকি এখন?’’
পুলক বললেন, ‘‘এটা লিখলাম!’’ সেই লেখা হল, বিখ্যাত গান ‘আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না।’ ১৯৭২ থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত মান্নার নন-ফিল্মি বাংলা গানের সংখ্যা ২০১টি। যার মধ্যে পুলকের লেখা গানের সংখ্যাই ১০৮! মান্নার জন্য সব থেকে বেশি গান লিখলেও, পুলকের লেখা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের সংখ্যাও কম নয়! হেমন্ত তাঁর গান প্রথম প্লে-ব্যাক করেন ৫০ সালে।
পুলক হেমন্তর জন্য লিখলেন দুর্ধর্ষ সব প্লে-ব্যাক। কেবল ছায়াছবি নয়, আধুনিকেও এই জুটির গানে গানে ছেয়ে ছিল স্বর্ণযুগ! পুলকের কথায় হেমন্তর প্রথম আধুনিক গান, ১৯৫৮ সালে। ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা’ এবং ‘কত রাগিণীর ঘুম ভাঙাতে’। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল গান দুটি। পরের বছর এই জুটির নিবেদন ছিল, ‘কোনদিন বলাকারা’ এবং ‘জানি না কখন তুমি’।

হেমন্ত-মান্নার মতো, বহু শিল্পীর চিরদিনের গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকের প্রথম বাংলা গানও তাঁর লেখা। হেমন্তর ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির ক্ল্যাপস্টিক দিতে কলকাতা এসে, লতা যেমন নিজেই ডেকে নিয়েছিলেন পুলককে। গিয়েছিলেন পুলক! পাহাড়িয়া সুরে কথা বসালেন সিগারেটের প্যাকেটে। লেখা হয়ে গেল বাংলায় লতার প্রথম পুজোর গান, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’! লতার মতো মুকেশও নিজেই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বাংলা গান করার। প্রথম ছবির গান, ‘সরি ম্যাডাম সরি’। পরে রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে পুলকের দুটি আধুনিক ছিল, ‘ওগো আবার নতুন করে’ এবং ‘দেহেরি পিঞ্জরে প্রাণ পাখি কাঁদে।’

এমন করেই অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সুমন কল্যাণপুর, উষা মঙ্গেশকর, চিত্রা ও জগজিৎ সিংহ, ঊষা উত্থুপ, উদিত নারায়ণ, অনুপ জলোটা, কুমার শানু’র প্রথম বাংলা গানও লিখেছিলেন পুলক। কিশোরকুমার তাঁকে ‘পোলাওবাবু’ ডাকতেন, লিখেছিলেন তাঁর জন্যও ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’, ‘মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ’-এর মতো চিরদিনের গান। লিখেছিলেন চিরশ্রবণীয়, আরতি মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গান ‘লজ্জা, মরি মরি এ কী লজ্জা।’

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩২ সালের আজকের দিনে (২ মে) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *