Press "Enter" to skip to content

গগনেন্দ্রনাথের চিত্রবিদ্যা শিক্ষার কোনো নির্দিষ্ট পথ লক্ষ্য করা যায় না। হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি প্রথম পাশ্চাত্য জলরঙে ছবি আঁকা শেখেন। পরে জাপানি শিল্পী ইওকোহামা (ওকাকুরু) এবং টাইকান (তাইকোয়ান)-এর দ্বারা তিনি প্রভাবান্বিত হন……।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাবলু ভট্টাচার্য : অবিস্মরণীয় প্রতিভায় যে ভ্রাতৃদ্বয় আধুনিক ভারতবর্ষের চিত্রশিল্পকে পৃথিবীর কাছে উপস্থাপিত করেছিলেন তাঁরা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গগনেন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের থেকে ৪ বছরের বড়ো ছিলেন।

জোড়াসাঁকোর এ জমিদার পরিবারের যুগপৎ খ্যাতি ছিল বিপুল বৈভব ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। ১৮৮১ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে পিতৃহারা হওয়ার পর তাঁর স্কুলের পড়াশুনা বন্ধ হয়, তার বদলে শুরু হয় জমিদারির কাজ এবং সে সঙ্গে পরিবারের প্রধান হিসেবে সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। নিজের বাড়িতেই তিনি বিশাল এক গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। স্কুলের বন্ধন ছিন্ন হওয়াতেই তিনি স্ব-শিক্ষার সুযোগ পান।

গগনেন্দ্রনাথের চিত্রবিদ্যা শিক্ষার কোনো নির্দিষ্ট পথ লক্ষ্য করা যায় না। হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি প্রথম পাশ্চাত্য জলরঙে ছবি আঁকা শেখেন। পরে জাপানি শিল্পী ইওকোহামা (ওকাকুরু) এবং টাইকান (তাইকোয়ান)-এর দ্বারা তিনি প্রভাবান্বিত হন। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির (১৯১২) জন্য কয়েকটি চিত্র তিনি অঙ্কন করেন যেগুলিতে জাপানি প্রভাব স্পষ্ট।

১৯০৭ সালে স্থাপিত ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট’ গগনেন্দ্রের প্রচেষ্টায় নবজীবন পায়। তিনি ধারাবাহিকভাবে শিল্প সম্বন্ধে বক্তৃতার পরিকল্পনা, ও.সি গাঙ্গুলীর সম্পাদনায় ‘রূপম’ নামক শিল্প সম্বন্ধীয় একটি পত্রিকার প্রকাশনা, প্রাচ্যরীতি অনুসারী প্রধান শিল্পীগণের অঙ্কিত চিত্রসমূহের প্রদর্শনীর আয়োজন করে সোসাইটিতে প্রাণসঞ্চার করেন। ১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে প্রথম প্রদর্শনী আয়োজিত হয়।

১৯১০ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে তাঁর সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য শিল্পকীর্তি হলো, হিমালয়ের স্কেচসমূহ, চৈতন্য-এর জীবন অবলম্বনে ধারাবাহিক চিত্রালেখ্য এবং ভারতীয় জীবনধারা অবলম্বনে অঙ্কিত অপূর্ব ব্যঙ্গচিত্রসমূহ। তাঁর এ শিল্প সম্ভার অবধূত লোক (১৯১৫), বিরূপ বস্ত্র (১৯১৭), এবং নয়া হুল্লোড় (১৯২১) এ ৩ খন্ডে প্রকাশিত হয়।

শিল্প সমালোচকগণ গগনেন্দ্র-এর ব্যঙ্গচিত্রসম্ভার ‘দক্ষতায় ও মৌলিকতায় অতুলনীয়’ বলে মন্তব্য করেন। ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপই তাঁর এসব চিত্রের বিষয়বস্ত্ত।

১৯২০ সালের পর গগনেন্দ্রনাথের শিল্পী জীবনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আধুনিক ফরাসি শিল্পের নানা উপাদান তিনি সাঙ্গীকরণের প্রয়াস পান। তিনি ফরাসি ত্রি-মাত্রিক রীতি ও জার্মান রীতির সংমিশ্রণ ঘটাবারও প্রয়াস চালান। ইউরোপীয় রীতির অন্ধ অনুকরণ তিনি কখনোই করেননি। জার্মান ও ফরাসি শিল্পীদের উদ্ভাবন কোলাজের (Collage) সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথের রচনার সম্বন্ধ অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ।

আলো-ছায়ার খেলার সার্থক রূপায়নই অঙ্কন শৈলীর ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অবদান এবং বহু চিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল রঙের অসাধারণ ঔজ্জল্য ও চাকচিক্য। জ্যামিতিক আকার প্রবর্তন গগনেন্দ্রনাথের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বিতীয় পর্বে লক্ষ করা যায়। ১৯৩০ সালের দিকে তাঁর চিত্রে মৃত্যু এবং অতিলৌকিক জগতের কিছু প্রতীকী অনুভূতি প্রকাশের লক্ষণ সুস্পষ্ট।

আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে কালি-তুলি কাজের পথিকৃৎ গগনেন্দ্রনাথ কেবল একজন চিত্রকরই ছিলেন না, দেশীয় ঐতিহ্য অনুসরণে আসবাবপত্রের নকশা অঙ্কনে তাঁর মৌলিকতা এবং অভ্যন্তরীণ গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য।

বিশ শতকের প্রথম দিকে স্বদেশী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকে সংরক্ষিত পাশ্চাত্য রীতির বিলাসবহুল ফুলদানি ও ভিক্টোরীয় আমলের আসবাবপত্র জোড়াসাঁকোর পৈতৃক বাড়ি থেকে সরিয়ে নেন। স্বদেশজাত দ্রব্যসম্ভারের পুনরুদ্ভাবনে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন।

বাংলার কুটির শিল্পকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজে তিনি প্রয়াসী হন এবং ১৯১৬ সালে বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল-এর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার গৃহনির্মিত কারুশিল্পের প্রচারার্থে স্থাপিত ‘বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর অন্যতম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অভিনয়কলাতেও গগনেন্দ্রনাথের দক্ষতা ছিল। তিনি জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৬) নাটক মঞ্চস্থ করেন এবং স্বয়ং রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেন। অ্যানী বেস্যান্ট তাঁর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ঋণশোধ-শারদোৎসব অভিনয়ে (১৯২২) সম্রাট বিজয়াদিত্যের ভূমিকায় এবং বৈকুণ্ঠের খাতার অভিনয়ে বৈকুণ্ঠ চরিত্রে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে রূপদান করেন।

মঞ্চসজ্জা, দৃশ্যপট রচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দেন। তিনি পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে তিব্বতি বকু ধরনের যে জোব্বা পরতেন তার নকশা সর্বপ্রথম গগনেন্দ্রই করেন।

গগনেন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে শিশু সাহিত্য ভোঁদড় বাহাদুর রচনা করেন। তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর এটি প্রকাশিত হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁর নানাবিধ আনুকূল্যে উপকৃত হয়েছে।

আধুনিক শিল্পের নানাদিকে গগনেন্দ্রনাথকে পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। অন্তর্দৃষ্টি ও প্রকাশভঙ্গির উজ্জ্বলতায় তাঁর চিত্রসম্ভার ভাস্বর। তাঁর চিত্রকলা প্যারিস, লন্ডন, হামবুর্গ, বার্লিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শহরে ১৯১৪ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে প্রদর্শিত হয়। এগুলি শিল্পের কঠোর সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়ায়।

প্রয়াণ হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ সালে।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৭ সালের আজকের দিনে (১৭সেপ্টেম্বর) জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.