পার্থ চক্রবর্তী : ২৬ মার্চ ২০২১। ঘরে আমি এসি লাগাইনি। গরমে যে কষ্ট হয় না তা নয়।কিন্তু জগতের কোনো কিছুই যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না,তখন ঘরের তাপ টা নিয়ন্ত্রণ করে কি লাভ? তার চেয়ে তার সাথে মানিয়ে নেওয়া এবং তাকে উপভোগ করা অনেক লাভজনক। গরমের দুপুরের গরম হাওয়া,উত্তপ্ত বিছানা, ঘামে ভেজা বালিশ, কোকিলের ডাক, সন্ধ্যের লেবু বা জুঁই ফুলের গন্ধ বেশ উপভোগ করি আনন্দ করে। আসলে সকল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারার মধ্যে,অথবা দুর্ভোগের মাঝে আনন্দ খোঁজার মধ্যে একটা মজা আছে। মনকে যদি তার স্বাদ দিতে পারেন তো দেখবেন, আপনি যোগী মানুষ।
ট্রেকিং করতে যাই যখন। পাহাড়ি দুর্গম পথে পিঠে ব্যাগ নিয়ে চড়াই ভেঙে ওঠা, পথে খানা খন্দ,বিপদ, ধ্বস। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হবে যেখানে সেখানে,খাবার কোনো ঠিক নেই। তবু যাই কেন? যাই নিজেকে জয় করতে,শরীর কে ঝালিয়ে নিতে, কনফিডেন্স অনেকটা বাড়িয়ে নিতে। এতেই আনন্দ খুঁজে পাই। বললে হাসবেন, আমি ভোটের ডিউটির মাঝেও একই রকম আনন্দ পাই। ঘাড় ধরে গর্তে নামিয়ে দেবার পর হ্যাঁচোড় প্যাঁচড় করে উঠে আসার যে আনন্দ, সেই আনন্দ পাই ভোটের সবকিছু নির্বিঘ্নে জমা দেবার পর।
ভোট মানেই জানবেন দুদিন,দুরাতের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম। ভোটের আগের দিন সাত সকালে বেরিয়ে ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারে গিয়ে গরম,লাইন,ঘাম,মাইকে হাঁকডাক, মেশিন মালপত্র বগলে করে পুলিশ ট্যাগ, শেষে বিরাট বাসের জঙ্গলের মধ্যে থেকে বাস খুঁজে,বাকি পার্টি নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা। বাণিজ্য জাহাজে শুনতাম একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল অচেনা অজানা লোককে জুটিয়ে দিয়ে জাহাজ ভাসিয়ে দেওয়া হত। এবার তুমি যেভাবে পারো সামলাও। এখানেও তাই,অজানা চারজন মানুষকে নিয়ে টিম। এবং খেলা শুরু। এই খেলায় অনভিজ্ঞ,অদক্ষ,অসুস্থ, অকর্মণ্য যেমন খেলোয়াড় ই পান না কেন,তাই নিয়েই খেলতে হবে,এবং জিততে হবে। বেশ মজার ব্যাপার না? এইভাবেই খেলতে হয়,এবং আমরা জিতি বারবার। চারজনের দুদিনের পরিবার। ভোট শেষ,সম্পর্ক শেষ। একই অভিজ্ঞতার সাক্ষী। রেশ টুকু নিয়ে আবার ফিরে যাওয়া নিজ নিজ জগতে। এই সম্পর্কে কোনো নাম নেই,শুধুই সংখ্যা,আমার প্রিসাইডিং,আমার ফার্স্ট পোলিং,এইরকম।
টেনশন করছেন। আরে ধুরমশাই। ফিল করুন সেই মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের দিনের সকালটা। বেশ নস্টালজিক লাগবে। আরে আমরা একদিনে দুই পেপার পরীক্ষা দেওয়া পাবলিক। সেটা যখন সফল ভাবে করতে পেরেছি, স্মৃতি থেকে জটিল কুটিল ফর্মুলা আর তথ্য দিয়ে মহাভারত রচনা করতে পেরেছি,তখন কটা ফর্ম ফিলাপ করে আসতে পারবো না? খুব পারবো। A,b,c,d স্ট্রিপ সিল নিয়ে ভাবছেন? যদি না মেলে। আরে কতো কি মিললো না জীবনে,তবু জোড়াতালি দিয়ে দিব্য আছি।সেই রকম ভাবে ফেভিস্টিক নিয়ে জুড়ে দেবেন। সিলটা আটকালেই হলো। অতো চাপ নেবেন না। ভোট সময়ে শুরু করা আর এক চাপ। অবশ্যই সময়ে শুরু করবেন। পারবেন। যদি না পারেন তাতেও চাপ নেবেন না। ঠান্ডা মাথায় কাজ চালিয়ে যাবেন। কেউ শো কজ করবে না ১৫/২০ মিনিট দেরির জন্য। ২০১৮ সালে ভারতের দূরপাল্লার ট্রেন গড়ে ২ ঘণ্টার বেশি লেট করেছিল সারা বছরভর।কেউ চাপ দেয় নি,কেউ চাপ নেয় নি। আপনিই বা চাপ নিয়ে শরীর খারাপ করবেন কেন। লাইন থেকে লোকে হই মারবে। না ঘাবড়ে মনে মনে মুচকি হাসুন। ভোট দেবার আকুলতা দেখে, গণতন্ত্রে আগ্রহ দেখে।
আলটিমেটলি কি হতে পারে? শো কজ। ইচ্ছাকৃত ভুল না করলে শাস্তি কিছুই হয় না। শো কজ হবে।আমার চেনা জানা কয়েকজনের হয়েছে। সরি চেয়ে এসেছেন। সাসপেন্ড, চাকরি যাওয়া কিছুই হয় নি। অতো সোজা না, মনে রাখবেন আমরা এই কাজের জন্য মাইনে পাই না।তাই আমাদের ভুল হওয়া স্বাভাবিক।ক্ষমা চেয়ে নেবেন। আর সেটা হলেও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এই ভেবেই নিতে হবে। দেখবেন হালকা ভাবে নিলেই সব সুন্দর মিলে যাবে।তবে কাজ নিখুঁত করার চেষ্টা করি সবসময়। ভুল করে আসা কাজের কথা না। ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ থাকবে,কিন্তু ক্যাজুয়াল হবো না।
আমার জানা দু একজনকে দেখেছি,তাদের থেকে শিখেছি কুল থাকা। একজনের ১২ টা নাগাদ মেশিন গেল খারাপ হয়ে। লাইনে দাঁড়ানো লোকেদের হইহই। ফার্স্ট পোলিং ঘামছেন টেনশনে। তিনি এসে আমার প্রিসাইডিং বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন,কি হবে স্যার? বন্ধু কুল,সেক্টরকে খবর পাঠিয়েছি।এই সুযোগ,এক এক করে খেয়ে আসি চলুন।এমন সুযোগ পাবেন না। মেশিন আমরা তৈরি করিনি,আমরা খারাপও করিনি।তাই আমাদের চাপ নিয়ে কাজ নেই। দুই ঘন্টা পর আবার মেশিন চেঞ্জ হলো।তারা তখন খেয়েদেয়ে চাঙ্গা। মোদ্দা কথা যা আমাদের হাতে নেই তার জন্য টেনশনে কাজ কি?
কতো প্রতিকূল পরিস্থিতি আসে। এই তো ১৮ সালের পঞ্চায়েত। ঝড় বৃষ্টি হয়ে দীর্ঘ লোডশেডিং। মোমের টিমটিমে আলো। তাতেই কাজ করতে হলো।চাপ পড়লো,কিন্তু করলাম ঠিকই। আবার এক জায়গায়, মেঝেতে বসে কাজ করছি,বিরাট এক কাঁকড়াবিছে এসে হাজির। মাটিতে বসে কাজ মাথায় উঠলো।তবে গনতন্ত্রের হুল ফোটাতে দিই নি। আর এক জায়গায় এজেন্টরা রাত্রে দেখা করতে এসে বললো পিছনের জানলা খুলবেন না।বিষাক্ত সাপ ঘরে ঢুকতে পারে।সেই আতঙ্ক নিয়েই ভোট করে এলাম। এক জায়গায় সারাদিন খাবার জুটলো না কিছুই। খালি পেটে ধর্ম হয় না,কিন্তু গনতন্ত্রকে সচল রাখতে হলো।এক জায়গায় আগের দিন এজেন্টরা এসে চমকালো,চুপ করে শুনে নিলাম।পরের দিন সেন্ট্রাল ফোর্স আসতেই স্ক্রু এঁটে দিলাম।একটা ফলস ভোট পড়তে দিই নি। বিষাক্ত চোখে তাকালো এজেন্টরা,আমি নির্বিকার তাচ্ছিল্য ভরে উদাসীন রইলাম।দেখ কেমন লাগে। এসব উটকো ঝামেলা থাকবে। অ্যাডজাস্ট করতে হবে। মানিয়ে নেওয়ার নামই জীবন। ভোটের বেশ কবার রাতটা প্ল্যাটফর্মে কাটিয়েছি। বেশ এক ভবঘুরে জীবনের ফিলিং।
আমার কাছে ভোট মানে বিপদ নয়, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। ভোট মানে জীবনের এক মিনিয়েচার। যেখানে পথে ফুল আর কাঁটা দুই থাকবে। কাঁটা বাঁচিয়ে ফুল কুড়িয়ে আনতে হবে। দু একটা ঠোক্কর, চড়াই উৎরাই,চ্যালেঞ্জ না থাকলে জীবন আলুনি। ভোট মানে রোমাঞ্চ,আর ফিরে আসার পর অনেকটা আত্মবিশ্বাস। এবারই দেখুন না, ফার্স্ট পোলিং এর ট্রেনিং করিয়ে প্রিসাইডিং এর চিঠি এলো, প্রাইমারীর বই পড়িয়ে মাধ্যমিকে বসিয়ে দেওয়া। বসিয়ে যখন দিয়েছে,জিতে আসবো। কাজকে ভয় কি,কাজ আমায় ভয় পাবে।এই আত্মবিশ্বাসটা ভোটই আমাদের দিয়েছে।
কাল থেকে শুরু হচ্ছে নির্বাচন।আমার মত বহু কর্মী নিযুক্ত তাতে। চাপ নিয়ে লাভ নেই,সব মিটবে ঠিকঠাক। ভোট হবে,অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হবে,নতুন নতুন গল্প তৈরি হবে। ভোট,ভোটার এর সঙ্গে ভোটেস্ট হয়ে সব কাজ করতে হবে আমাদের। গনতন্ত্রের চাকর হিসাবে বোঝা বইবার জন্য সমস্ত ভোটকর্মীদের জানাই শুভেচ্ছা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার — পার্থ চক্রবর্তী।
Be First to Comment