স্মরণঃ কৃষ্ণচন্দ্র দে
বাবলু ভট্টাচার্য : কৃষ্ণচন্দ্র দে বাংলা সঙ্গীতের একজন আদি ও প্রবাদ পুরুষ, কিংবদন্তীর কণ্ঠশিল্পী, সিনেমা ও থিয়েটার অভিনেতা, থিয়েটার প্রযোজক ও সঙ্গীত পরিচালক। তিনি ছিলেন অপর কিংবদন্তী শচীনদেব বর্মণের প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র হলেন সুবিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মান্না দে।
কৃষ্ণচন্দ্র দে ১৩ বছর বয়সে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারান বলে, তিনি ‘অন্ধ গায়ক’ নামেও সমধিক পরিচিত। জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৩ সনের আগস্ট মাসে। দিনটি জন্মাষ্টমীর ছিল বলে তাঁর বাবা, শিবচন্দ্র দে ও মা রত্নমালা দেবী তাঁদের ছেলের নাম রাখেন শ্রীকৃষ্ণের নামে, তথা, কৃষ্ণচন্দ্র দে। বাল্যকাল থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল।
নিয়তির পরিহাস, ১৯০৬ সালে, আকস্মিক মাথার যন্ত্রণা থেকে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকেন, সেকালের চিকিৎসার সীমাবদ্ধতার কাছে হার মেনে তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সেই অন্ধত্ব বরণ করেন।
কিন্তু যার প্রতিভা প্রায় সীমাহীন, তাঁকে রুখবে কে? কিশোর কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গীত শিক্ষাজীবন শুরু হয় শশীভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে, ক্রমান্বয়ে তিনি উস্তাদ বাদল খানের কাছে খেয়াল, দানী বাবুর কাছে ধ্রুপদ, রাধারমণের কাছে কীর্তন ও কণ্ঠে মহারাজের কাছে তবলা শেখেন।
১৯১৭ সনে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়, তারপরের নিস্তরঙ্গ ছয়টি বছর যায় সঙ্গীত সাধনায়। এরপর সঙ্গীতে ম্যাচিউরড কৃষ্ণচন্দ্রের আবির্ভাব হয়, অপর প্রবাদপুরুষ, শিশির ভাদুড়ির থিয়েটারে। শুরু হয় গান ও অভিনয় দিয়ে থিয়েটার জয়। একের পর এক নাটক সফল হতে থাকে অন্ধ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গীত ও অভিনয়ের উপর ভর করে।
অবশেষে, ১৯৩১ এ কৃষ্ণচন্দ্র নিজের থিয়েটার কোম্পানি খোলেন। এবার তিনি একইসাথে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। তাঁর নতুন থিয়েটারে শিশির ভাদুড়িও অভিনয় করেন। বাংলা থিয়েটারের উন্নতিই তখন কৃষ্ণচন্দ্রের ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। এর মধেই শুরু হয় সিনেমার যুগ।
১৯৩১-এ, নাটকে ব্যস্ত কৃষ্ণচন্দ্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রথম ‘টকি সিনেমা’য় দুটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩২ এ নির্মিত ‘চণ্ডীদাস’ সিনেমার মাধ্যমেই কৃষ্ণচন্দ্রের সিনেমা অভিযান শুরু হয়। চণ্ডীদাসে তিনি নাম ভুমিকায় অভিনয় ও কণ্ঠদান, এই দুইই সাফল্যের সাথে করেন। এই সাফল্য থেকেই একজন এনটারটেইনার হিসাবে তাঁর প্রকৃত বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শুরু হয়।

১৯৪২-এ কৃষ্ণচন্দ্র বম্বেতে আবাস গড়ে হিন্দি সিনেমায় মনোনিবেশ করেন। যথারীতি, হিন্দি সিনেমায় অভিনয়, কণ্ঠদান, সঙ্গীত পরিচালনা সবই তিনি আগের মতোই সফলভাবে করতে থাকেন। তাঁর গানগুলো লোকসঙ্গীত আশ্রিত হওয়ায়, সহজেই সকল শ্রেণীর শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর কীর্তন, বাউল ও ভাটিয়ালি গানগুলো ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৪৭ সালে কৃষ্ণচন্দ্র যথারীতি অভিনেতা, গায়ক হিসাবে, বাড়তি যোগ হয় সিনেমা প্রযোজনা। পরপর বেশ কয়েকটি সফল সিনেমার পর, ১৯৫৭ সালে ‘একতারা’ সিনেমায় অতিথি শিল্পী হিসাবে জীবনের শেষবারের মতো পর্দায় আবির্ভূত হন।
কৃষ্ণচন্দ্র দে ১৯৬২ সালের আজকের দিনে (২৮ নভেম্বর) কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

Be First to Comment