স্মরণ : ফিদেল কাস্ত্রো
বাবলু ভট্টাচার্য : সারা বিশ্বে যখন কমিউনিস্ট সরকারগুলো ধসে পড়ছে ঠিক তখন কমিউনিস্ট ব্যবস্থার বৃহত্তম শত্রু বলে পরিচিত আমেরিকার দোরগোড়াতেই সমাজতন্ত্রের ধ্বজা তুলে ধরে রেখেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।
তার সমর্থকেরা তাকে সমাজতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতেন, যিনি জনগণের কাছে কিউবাকে ফেরত দিয়েছিলেন। অর্ধ শতাব্দী ধরে একদল বিশিষ্ট কিউবার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।
১৯২৬ সালের ১৩ অগাস্ট জন্ম হয় ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজের।
স্পেন থেকে কিউবাতে আসা একজন ধনী কৃষক আনহেল মারিয়া বাউতিস্তা কাস্ত্রোর অবৈধ সন্তান ছিলেন তিনি।
পিতার খামারের ভৃত্য ছিলেন মা লিনা রুৎজ গনজালেজ, যিনি পরবর্তীতে ছিলেন তার পিতার রক্ষিতা। ফিদেলের জন্মের পর তার মাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন তার পিতা।

সান্টিয়াগোর ক্যাথলিক স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফিদেলের। পরে তিনি যোগ দেন হাভানার কলেজ এল কলেজিও ডে বেলেন-এ। তবে খেলাধুলার দিকে বেশি মনযোগ থাকার কারণে পড়াশোনায় খুব ভাল করতে পারেননি তিনি।
১৯৪০-এর দশকে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়বার সময়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৮ সালে কিউবার ধনী এক রাজনীতিবিদের কন্যা মার্টা ডিয়াজ বালার্টকে বিয়ে করেন মি. কাস্ত্রো। এই বিয়ের মাধ্যমে দেশটির এলিট শ্রেণীতে যুক্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল তার, কিন্তু তার বদলে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলেন মার্ক্সবাদে।
তিনি বিশ্বাস করতেন কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কারণে দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব এবং একমাত্র জনগণের বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর পর আইন পেশা শুরু করেন। কিন্তু এই পেশায় তিনি সফল হতে ব্যর্থ হয়ে দেনায় ডুবে যান তিনি। এই পরিস্থিতিতেও রাজনীতি অব্যাহত রাখেন। প্রায়ই সহিংস বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়তেন তিনি।

১৯৫২ সালে ফুলগেন্সিও বাতিস্তা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রিয়র সরকারকে উচ্ছেদ করেন। বাতিস্তার সরকারের নীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, যা ছিল কাস্ত্রোর বিশ্বাসের পরিপন্থী। ফলে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের জন্য তিনি একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন যার নাম ‘দ্য মুভমেন্ট’।
এসময় কিউবা পরিণত হয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের স্বর্গরাজ্যে। যৌন ব্যবসা, জুয়া এবং মাদক চোরাচালান চরম আকার ধারণ করেছিল।
সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩-র জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মোনাকাডা সেনা ছাউনিতে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো। কিন্তু আক্রমণটি ব্যর্থ হয় এবং বহু বিপ্লবী নিহত হয় নয়তো ধরা পড়ে। বন্দীদের মধ্যে কাস্ত্রোও ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তার বিচার শুরু হয়।
বিচারের শুনানিগুলো কাস্ত্রো ব্যবহার করতেন সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেয়ার মঞ্চ হিসেবে। এ সময় শুনানিগুলোতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল, ফলে কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা এসময় বেড়ে যায়। কাস্ত্রোকে অবশ্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।
সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের মে মাসে জেল থেকে ছাড়া পান কাস্ত্রো। জেলে থাকার সময়েই স্ত্রীকে তালাক দেন তিনি এবং মার্ক্সবাদে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েন। ছাড়া পাওয়ার পর ফের গ্রেপ্তার এড়াতে মেক্সিকো পালিয়ে যান তিনি। সেখানে তার পরিচয় হয় আরেক তরুণ বিপ্লবী আরনেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে।
১৯৫৬ সালের নভেম্বরে ১২ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইঞ্জিন নৌকায় ৮১ জন সশস্ত্র সঙ্গীকে নিয়ে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল কাস্ত্রো। তারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে আশ্রয় নেন এবং এখান থেকে হাভানার সরকারের বিরুদ্ধে দু বছর ধরে গেরিলা আক্রমণ চালান।
১৯৫৯ সালের দোসরা জানুয়ারি বিদ্রোহীরা হাভানায় প্রবেশ করে। বাতিস্তা পালিয়ে যান। এ সময় বাতিস্তার বহু সমর্থককে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এসব বিচার কার্যক্রমকে অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকই ‘অনিরেপক্ষ’ বলে মনে করেন।
বিপ্লবের সময় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া এবং এর নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে মিত্রতা তৈরি হয় কাস্ত্রোর। ফলে কিউবা পরিণত হয় ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রো সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায় একদল নির্বাসিত কিউবানকে দিয়ে দ্বীপটি দখল করিয়ে নেবার মাধ্যমে। ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়, বহু মানুষ এসময় নিহত হয়, হাজার খানেক মানুষ ধরা পড়ে।
এই ঘটনা পরবর্তীতে কিউবা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ফিদেল কাস্ত্রো আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হন। সিআইএ তাকে হত্যার চেষ্টাও করে।

মি. কাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবায় অবশ্য বহু অভ্যন্তরীণ উন্নয়নও হয়েছে। দেশটির প্রতিটি নাগরিকই বিনামূল্যে উন্নত চিকিৎসা সেবা পায়। বিশ্বের বহু উন্নত দেশের তুলনায় কিউবায় শিশুমৃত্যুর হার কম। শাসনামলের শেষ দশ বছরে নিজের বিপ্লবকে বাঁচাতে মুক্ত বাণিজ্যের কিছু কিছু দিক গ্রহণ করতে বাধ্য হন মি. কাস্ত্রো।
কাস্ত্রো চাননি, তাই কিউবায় গেলে তার নামে কোনো রাস্তা কিংবা তাকে শ্রদ্ধা জানাতে কোনো স্মৃতিস্মারকের দেখা পাওয়া যাবে না৷ কিন্তু তারপরও তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে৷ কাস্ত্রোর চিন্তাধারা স্কুলে পড়ানো হয়৷ অনেক সরকারি ভবনে তার ছবি এখনও ঝোলানো আছে৷ অর্থাৎ কিউবার মানুষের কাছে কাস্ত্রোর মৃত্যুতে কিউবা খুব কম পরিবর্তনই এসেছে৷
ফিদেল কাস্ত্রো ২০১৬ সালের আজকের দিনে (২৫ নভেম্বর) কিউবাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Be First to Comment