স্মরণ : ঈ শ্ব র চ ন্দ্র বি দ্যা সা গ র
বাবলু ভট্টাচার্য : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত, হিন্দি এবং ইংরেজি থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদকৃত গ্রন্থের মধ্যে ‘সীতার বনবাস’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘বেতাল পঁচিশ’ এবং ‘কথামালার গল্প’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এসব ছাড়াও তাঁর রচিত ‘বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ’, ‘বোধোদয়’ এবং ‘আখ্যানমঞ্জুরী’ গ্রন্থখানি আজও বাংলাভাষা গোড়াপত্তনে অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।
প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ‘বিদ্যাসাগর’ নামেই বেশি পরিচিত। উনবিংশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকারকে অনেকেই আধুনিক বাংলা ভাষার জনক হিসেবে অভিহিত করেন।
তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বাঙালি সমাজে প্রগতিশীল সংস্কারের একজন অগ্রদূত।
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতী দেবী।
ছেলেবেলায় গ্রামের পাঠশালাতে পড়তেন ঈশ্বরচন্দ্র। পাঠশালার পাঠ শেষ করে আরও শিক্ষালাভের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতায় পৌঁছান পায়ে হেঁটে, তখন তার বয়স মাত্র আট পেরিয়েছে।
কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ থেকে খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। এখান থেকেই ১৮৪১ সালে তাকে অগাধ জ্ঞানের জন্য বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয় হয়। পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।
তিনি ছয় মাসে বাংলার মেয়েদের জন্য প্রায় ৪০টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সারা জীবন লড়াই চালিয়েছিলেন। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বিধবা বিবাহ প্রচলনের দাবিও তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় যে হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটিই ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাতেও পারদর্শী ছিলেন। সাঁওতাল এবং দরিদ্রদের মধ্যে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। হোমিওপ্যাথি শিক্ষার জন্য তিনি বাড়িতে সেই সময় তার ষাট বছর বয়সে কঙ্কাল কিনে এনে অ্যানাটমি শিখেছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণপুরুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে, পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মের কথা, ধর্মনীতির কথা বাদ দিয়ে দাও। পাঠ্য গ্রন্থে ধর্মের কথা বলতে গেলে ছাত্রদের মন প্রথম থেকেই নিজের স্বাভাবিকতা থেকে ধর্মের দিকে চলে যায়।
বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিন যুগান্তকারী বাংলা শিশুপাঠ্য বর্ণমালা শিক্ষাগ্রন্থ বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।
সর্বস্তরের জন্য শিক্ষা বিষয়ক বই, শিশুদের বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তাঁর কিছু কিছু পাঠ্যপুস্তক কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালি শিশুদের মৌলিক শিক্ষার প্রধান বাহন হয়েছে।
১৮৪৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্থাপন করেছিলেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে বইয়ের দোকান। ওই বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। প্রথম বিরাম চিহ্নের সফল ব্যবহার করা হয় এই গ্রন্থে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১সালের আজকের দিনে (২৯ জুলাই) ৭১ বছর বয়সে কলকাতায় পরলোক গমন করেন।
Be First to Comment