ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত ম্যাজিশিয়ান ও বিশিষ্ট লেখক। ২২, নভেম্বর, ২০২০। গুজরাটে ইন্দ্রজাল দেখাতে গিয়ে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর, হৃদয়স্পর্শী এবং তথ্য-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাটা হয়েছে ওখানকার ‘লোথাল’ অঞ্চল পরিদর্শন করে।
‘লোথাল’ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার অঙ্গরাজ্য, এক নগর বন্দর। অসাধারণ প্ল্যনে তৈরি এক বিজ্ঞানে উন্নত বাণিজ্য নগরী। জোয়ারের সময় জলে ভাসিয়ে জাহাজকে নগরীর একদম কেন্দ্রস্থলে বিশাল জলাশয়ে এনে আটকে ভাটায় যখন জল কমে শুকনো হতো, তখন মাল-পত্তোর খালাস করা হতো। পরে আবার রপ্তানি করার মাল ভরে জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করে, জাহাজ ভেসে উঠলে নদীতে ফিরে এদেশ-সেদেশ পারি দিতো। বঙ্গভূমির তাম্রলিপ্তী (তমলুক), গঙ্গে (সাগর দ্বীপের)-এর সঙ্গে, ওদিকে মিশর, ইটালী, গ্রীসের সঙ্গেও ব্যবসার যোগাযোগ ছিল। সে কতদিন আগেকার কথা। আর্য্যরা সবে ভারতের বাইরে পশ্চিম দিকে সভ্যতা বিস্তার করতে বরুণের পরিচালনায় বৈদিক মতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে আলাদা হবার প্ল্যান করছে। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, মেহেরগড়ের তখন বিশ্বব্যাপী সুনাম।

যীশু খৃষ্টের জন্মের তিন-চার হাজার বছর আগেকার কথা।
লোকাল সভ্যতা হঠাৎ হয়ে গেল ভ্যানিশ। এদিকে ওদিকে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু কিছু চিহ্ন। চিনতে ভালোবাসার চোখ চাই। একটা মানুষও নেই ওদের হয়ে কিছু বলার। আক্ষরিক অর্থে স্থানীয় ভাষায় ‘লোথাল’ কথাটার মানে হচ্ছে মৃত্যুপুরী। এখানে সবাই মৃত।
আমার কিন্তু তার মনে হয়নি। ওরা ভীষণ রকম জীবিত। আকাশে,বাতাসে,বালিতে,রোদে,মিশে থেকে ঘুমিয়ে আছে। ওখানে ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেন নিষিদ্ধ জানিনা। বরঞ্চ এখানে মানুষের চলাচল করার ওপর নিষেধাজ্ঞা। জারি করা উচিত ছিল। পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে সভ্যতার ছোট বেলার স্মৃতি। আমি, জয়শ্রী এবং আমাদের তিন কন্যে, সন্তর্পণে, পা টিপে, শ্রদ্ধার সঙ্গে ওদের রাজপথে, অলিতে-গলিতে হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে বেড়াই। মনে হচ্ছিল, ঐ বিশাল স্তব্ধ বাণিজ্য বন্দরে অদৃশ্য ভাবে আমাদের চারদিকেই পূর্বপুরুষ রাত হেঁটে বেড়া -চ্ছেন। হাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজে তাঁদের ফিস্-ফিসানি এবং আশীর্বাণী শুনতে পাই। আমরা মামীকে প্রণাম করি।
পাঁচ হাজার বছর আগে সব স্তব্ধ হয়ে যায় একদিনে। ‘লোথাল’ চাপা পড়ে যায় এক রাতে, লাগাতার ভূমিকম্পের কারণে, নিজের তৈরি ইমারতের ধ্বংসাবশেষের তলায়। এখন ওদের মিউজিয়ামে তাদের এ আমলে ব্যবহৃত কতকিছু সাজিয়ে রাখা আছে। সব আছে, নেই শুধু সেই মানুষজন।

নেই ? কে বললো নেই? আমরা তাহলে কারা? আমরা এলাম কোত্থেকে? আমাদের রক্তে তো তাদের রক্ত বইছে । যারা ঐ দূর্যোগের পরও বেঁচে ছিলেন, তাঁরা জাহাজে চেপে বিভিন্ন নিশ্চিন্তির দেশে আশ্রয় নেন। বঙ্গ ভূমির প্রাচুর্য,সমৃদ্ধি এবং আতিথেয়তার কথা তাঁদের জানাই ছিলো বিভিন্ন সওদাগরদের দৌলতে।। সেজন্য হরপ্পার অনেকেই নাকি চলে আসেন এই “গঙ্গারিডী” দেশে। আমাদের এখানে। গ্রিকদের দৌলতে আমাদের দেশ তখন ঐ নামেই পরিচিত ছিলো। তাম্রলিপ্তি, গঙ্গে, এবং চন্দ্রকেতূগড়ে এসে বাঙালির সাথে তাদের রক্তের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।… আমরা তো তাদেরই উত্তরসূরী! আমরা জাতে ‘নিষাদ’। সাঁওতালি,অস্ট্রিক,আর দ্রাবিড় রক্তের মানুষ আমরা। আর্য রক্তের ভাগ কম।
লোথালের মিউজিয়ামে আমরা গিয়েছিলাম।অনেক বই কিনি। আমাদের উৎসাহ দেখে একজন কর্তাব্যক্তি আমাদের এক বিশেষ কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে এক আমরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখি। আমি নিজে চোখে তাঁদের সেকালের এক দম্পতিকে পরম নিশ্চিন্তে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখি।পা টিপে টিপে তাঁদের অন্তঃপুরে নির্লজ্জের মতো নিঃশব্দে বুকে উঁকি মেরে দেখেছি-কাচের বাক্সে তাঁদেরকে কী যত্ন করে রেখে দেওয়া আছে। সেই দূর্যোগের রাতে তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। হৃদয়ের কাছাকাছি হয়ে। জানতেও পারেননি সেই প্রলয়ঙ্করী দূর্যোগের ভয়াল থাবার কথা। ধ্ব-সস্তূপের ধূলো-বালি-ইট-পাথরে হঠাৎ করে চাপা পড়ে যান অনন্তকালের জন্য, ঐ আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায়। সাড়ে পাঁচ হাজার পর তাঁদের ভঙ্গুর দেহ উদ্ধার করে, ঠিক সেই অবস্থাতেই রাখা হয় মিউজিয়ামে । আমরা কাছে যাইনি। দূরত্ব বজায় রেখে, তাঁদের আব্রুকে সম্মান জানিয়ে, নমস্কার করেই চলে আসি। আইনকে সম্মান জানিয়ে , ছবি তুলিনি। তবে পরবর্তী কালে কয়েকটা কপি পেয়েছি তথ্য দপ্তরের আনুকূল্যে। সেগুলো এখানে প্রকাশ করলাম।
দলের সবাই আমাকে ‘মেজদা’ বলে থাকেন।আমরা তিন ভাই। আমি মেজ। সেই সুবাদে ওদের কাছে ‘মেজদা’।

অনেক বই ঘেঁটে এবং স্থানীয় পণ্ডিতদের সহায়তায় আমি প্রথমে ‘মেজদা’, তারপর ‘প্রদীপ সরকার’ নাম দুটো হরপ্পার লিপিতে লিখতে পেরেছি। এখানে হরপ্পার হরফে ‘প্রদীপ’ সরকার’ নামটা সই করে দিলাম। বিশ্বের প্রাচীনতম ভাষায়। আমাদের দেশ নিয়ে আমার বুকভরা গর্বের সাথে।
জাদুশিল্পী প্রদীপ চন্দ্র সরকার।

Be First to Comment