শতরূপা সান্যাল : চলচ্চিত্র প্রযোজক ও বিশিষ্ট পরিচালক।
এক একটি বেনীর জন্যে এক পেনি করে ধার্য করেছিল ওরা।
মনে আছে।
কলম্বাস আবিস্কার করল যেই আবাদী ভূখন্ড
আমার বাস ছিল সেখানে।
সে ছিল আমাদের দেশ। আমার বাপ ঠাকুরদার।
রেড ইন্ডিয়ান নাম দিয়েছিল আমাদের।
দীর্ঘ দেহ, শক্ত পেশী, তামাটে চামড়া
আর কালো চুলে লম্বা বেনী বাঁধতাম সবাই।
মেয়ে মরদ সবারই সেই দস্তুর ছিল।
রংবেরঙের পাখির পালকের মুকুট পরতাম আমি।
আমি যাকে ভালোবাসতাম, একদিন সে আমার পুরুষ হল।
আমাদের গোষ্ঠীতে সেদিন উৎসব।
আগুন জ্বলল, ঝলসানো মাংস আর
দেশি মদের সে কি ভোজ!
কী আনন্দে ভালোবাসায় ভেসে যেত আমার দিনগুলো।
ঠিক সেই সময়েই ওরা এলো
পিশাচের মত, ডাকাতের মত, প্রেতের মত।
আমরা ওদের বন্ধু ভেবেছিলাম
ক্রমে ওদের ভয় পেতে শুরু করলাম ।
সাদা চামড়ার ঘোড় সওয়ার, হাতে আগুন ছোটানো কল।
জাহাজ ভাসিয়ে এসেছিল ওরা।
সেদিন ছিল পূর্নিমা।
গোল চাঁদ টলমল করছিল কলোরাডোর জলে।
আমি আর আমার পুরুষ চাঁদের আদর গায়ে মেখে
কতক্ষণ শুয়েছিলাম নরম তৃণের মাদুরে।
দূর থেকে হঠাৎ কিসের যেন হল্লা
চেয়ে দেখলাম, আমাদের ঘরগুলো জ্বলছে দাউদাউ!
আমার পুরুষ বলল, পালাও!
ওরা হামলা করতে এসেছে। এই ভূখন্ড ওরা দখল নেবে
নিকেষ করবে আমাদের সব মেয়ে মরদদের।
ওরা আমাদের মেরে মাথাটা কেটে নিয়ে গেলে
ইনাম পাবে একটা করে পয়সা
একটা বেনী একটা পেনি!
পালাও, প্রিয়তমা!
পালাচ্ছিলাম। ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে আরো ঘন জঙ্গলের দিকে।
সকাল হলে দেখলাম, আমি একা।
কোথায় গেলো সে? আমার পুরুষ? আমার মরদ?
পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ঘরগুলো তখনও
ধোঁয়া উগরোচ্ছিল।
বেঁচে ছিল একমাত্র এক বুড়ি ঠাকুমা।
আমায় দেখে সে বুক চাপড়ে কেঁদে বলল,
বাঁচতে চাস তো পালা!
নদী পেরিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে মহাদেশ পেরিয়ে
ঐ গ্রহ নক্ষত্র তারাদের পেরিয়ে চলে যা
যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা আছে।
মৃত্যুর পর সবাই যেখানে যায়।
আমি তো সেখানে যেতে চাইনা।
আমি আমার প্রেমিক, আমার মরদকে চাই।
খুঁজেও পেলাম তাকে, খুন হয়ে যাওয়া দেহগুলোর স্তুপে।
বুক তার এ ফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে আগুন ছোটানো
কলের চুমোতে!
সাদা মানুষের মাথার ভিতর কতনা কালো অন্ধকার!
লোভ, হিংস্রতা, দখলদারির অমাবস্যা।
আমার মানুষটার কুচকুচে কালো লম্বা বেনীটা
কেটে নিয়েছিলো ওরা।মাথাটাও।
যার দাম ওরা ধার্য করেছিল এক পয়সা।
কবি – শতরূপা সান্যাল
Be First to Comment