ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫। আগামীকাল “একুশে ফেব্রুয়ারি ” , ১৯৫২র এই রক্ত ঝরানো দিনটি আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত ৷
গাজী উল হক এদিনে প্রথম গান লিখেছিলেন ,
“ভুলবো না ভুলবো না এ একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবোনা ” না বাঙালি ভোলে নি কারন কবেই অতুল প্রসাদ সেন লিখে গেছেন , ” আ মরি বাংলা ভাষা / মোদের গরব , মোদের আশা ” ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্য “নূরনামা ” তে আবদুল হাকিম মাতৃভাষা বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন ,
” যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ৷/ সে সবার
কিবা রীতি নির্ণয় না জানি ” ৷ বাঙালি তার উত্তরাধিকার ৷ তাই দেখি মানভূমের বাঙালিরা বাংলার দাবীতে ” পুরুলিয়া ” ছিনিয়ে নিয়েছে ৷
১৯শে মে ১৯৬১কাছাড়ে বাংলা ভাষার নায্য দাবীতে কমলা ভট্টাচার্যের মত মেয়ে সহ ১১ জন আত্মবলি দিয়েছেন ৷বরাক উপত্যকার বাঙালিরা তা প্রমাণ করে ৷পাকিস্তানে সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবীতে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আবদুস সালাম , রফিকউদ্দিন আহমেদ , আবুল বরকত , আবদুল জব্বারের মত শহীদদের রক্তদানের পরিণতি আজকের “বাংলাদেশ ” , বাংলা ভাষার দেশ !
পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমেদ ৷ বরকত আমাদের মুর্শিদাবাদের সালারের বাবলা প্রামের সন্তান ৷
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকেও জাতীয় ভাষা করতে হবে ৷ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ১৯৪৮সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম সেই দাবী তুলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ৷ তাঁকে সর্মথন
করেছিলেন প্রেমহরি বর্মা , ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৷ সফল আইনজীবী ধীরেন বাবুকে পাক সেনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৯মার্চ কুমিল্লার বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ৷” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি ” আবদুল গফফর চৌধুরির লেখা আলতাফ মামুদের সুরারোপিত গানটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় গান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে ৷ জহির রায়হান ” জীবন থেকে নেওয়া ” ছবির মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ৷একুশের প্রথম কবিতা ছিল মাহবুবুল আলম চৌধুরির ” কাঁদতে আসিনি
ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি ” আজ সার্থক হয়েছে ৷ ইউনেসকো কানাডায় বসবাসকারী দুই বাংলাদেশী
রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন দেশের একদল মাতৃভাষা প্রেমিকদের সংগঠন
” Mother language of the world ” এর দাবী মেনে ১৯৯৯ সালে এই দিনটিকে ” আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের ” স্বীকৃতি দিয়েছেন ৷ ১৮৬টি দেশ এই অঙ্গীকারে সাক্ষর করেছে ৷আজ তাই একুশ শুধু বাঙালির নয় ৷ বিশ্বের সবখানের সব ভাষার মানুষের ৷ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ ৷ এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে শুধু ভাষা নয় ৷ হাজার বছরের সংস্কৃতি ৷প্রত্যেকের উচিত নিজের নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসা ও তাকে রক্ষা করা ৷আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর অনেক ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে বেঁচেছে ৷ SIL international র মতে পৃথিবীতে ৬৯১২ টি ভাষা প্রচলিত ৷ আমাদের ভারতে প্রচলিত ১৬৫২ টি ভাষা ৷ যার অনেকগুলি করে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে ৷ যত ছোট ভাষাই হোক লিপি থাকুক না থাকুক নিজস্ব কৃষ্টি ও লোককথার ধারক ৷ যা তার নিজস্বতা ৷ উচিত প্রতিটি মানুষের ভাষাকে সম্মান করা ৷তাই মাত্র তিন লক্ষ জনসংখ্যার ” বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরাও ” নিজের ভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন ৷পৃথক তেলেগু রাজ্যের দাবিতে চেন্নাইয়ের মালয়াপুরের নিজ বাড়ীতে গান্ধীবাদী নেতা রামুলু ৫৮ দিন অনশন করে মৃত্যু বরন করেন৷ তাঁর মৃত্যু তেলেগু ভাষীদের হিংসাত্মক করে তুললে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে ৭ জনের মৃত্যু হয় ৷ অবশেষে তৈরী হয় পৃথক অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ৷ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন হিব্রু ভাষাকে ইজরাইল পুনর্জীবিত করেছে ৷ পৃথিবীর দশটি বৃহৎ ভাষার মধ্যে কারো মতে চতুর্থ কোন মতে ষষ্ঠ বৃহত্তম আমাদের বাংলা ভাষা ৷ যা ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা৷ বাংলাদেশের এই রাষ্ট্রভাষাকে আফ্রিকার দেশ ” সিয়েরা লিওনও ”
অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে ৷ সেদেশে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে ৷ পশ্চিমবঙ্গ
ও ত্রিপুরার প্রধান রাজ্যভাষা ” বাংলা ” ৷ যে ভাষায়
লেখা হয়েছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ” জনগনমন” ৷ আবার বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ” আমার সোনার বাংলা “৷
আমরা যেন সেই পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও সুমিষ্ট “বাংলা ভাষাকে ” না অবহেলা করি ৷ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ , যার বিকল্প হয় না ৷ তাই মাইকেল বিদেশী সাহিত্যে পারঙ্গম হয়েও ফিরে এসেছিলেন ৷ আমার শ্রদ্ধেয় আসাদ চৌধুরীর কলমে তাই বলি , ” ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে / থেকে থেকেই ডাকে / তাকে তোমরা কোকিল বলবে ? বলো ৷ আমি যে তার নাম রেখেছি আশা / নাম দিয়েছি ভাষা ,” ৷
॰
Be First to Comment