বাবলু ভট্টাচার্য : ঢাকা।
আবদুস সালাম —
ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষণপুর (বর্তমানে সালামনগর) গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর জন্ম হয় আবদুস সালামের। তার পিতা ফাজিল মিয়া কৃষিজীবী ছিলেন। পরিবারের আর্থিক অভাব অনটনের কারণে পাঠ চুকিয়ে জেঠাতো ভাই এর হাত ধরে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মতিঝিল ‘ডাইরেক্টার অব ইন্ডাষ্ট্রিজ’ এ পিয়নের চাকুরি নেন।
৫২’র ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সালাম বাড়িতে আসনে এবং কিছুদিন ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরে যান। তখন মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে রাজধানী ছিল আন্দোলন মুখর। ২৭ বছরের টগবগে যুবক সালাম জাতির জন্য, মায়ের ভাষার জন্য আন্দোলনে যোগ দেন। ছুটে যান মিছিলে।
২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গনে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। সেই মিছিলে তিনিও যোগ দেন। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের বর্বরোচিত গুলিবর্ষনে লুটিয়ে পড়েন, সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিকসহ অনেকে। বুলেটবিদ্ধ সালামকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন সংজ্ঞাহীন থাকার পর ৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
২০০০ সালে ফেনী জেলার একমাত্র স্টেডিয়াম ভাষা শহীদ সালামের নামে নামকরণ হয়। শহীদ সালামের জন্মস্থান লক্ষ্মণপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে সরকারী ভাবে সালাম নগর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সালে সরকার শহীদ আবদুস সালামকে মরনোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করেন।
রফিক উদ্দিন —
রফিক উদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামে। বাবা আবদুল লতিফ। মা রাফিজা খাতুন। ১৯৪৯ সালে মানিকগঞ্জের বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর রফিক উদ্দিন ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনা করতে শুরু করেন। এ সময়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রফিকই প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। তাই বলা যায় তিনিই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ।
আবুল বরকত —
ভাষা শহীদ আবুল বরকতের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৩ জুন। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহাকুমার ভরতপুর থানার বাবলা নামক একটি ছোট গ্রামে। বাবা শামসুজ্জোহা। মা হাসিনা বিবি।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রাম তালিবপুর ইংলিশ হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকার পুরানা পল্টনে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে তার মামা আব্দুল মালেক সাহেবের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ওই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে তিনি অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন এবং এমএ শেষ পর্বে ভর্তি হন।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। ভাষা আন্দোলনের ঢেউ আবুল বরকতকে আলোড়িত করে। তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবীতে আন্দোলোন তীব্র হয়ে উঠে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে।
তলপেটে গুলি লেগেছিল বরকতের। দু’তিন জন ছুটে এসে সুঠামদেহী বরকতকে কাঁধে তুলে জরুরী বিভাগের দিকে দৌড়াতে থাকেন। ডাক্তাররা তাকে বাঁচানো জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের জন্য সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী রাত ৮টার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী ওয়ার্ডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শফিউর রহমান —
ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোন্নগরে ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারী। তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করে কলকাতার গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে তিনি আইকম পাস করেন। শফিউর রহমান চব্বিশ পরগনা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানীর চাকরি শুরু করেন।

২২ ফেব্রুয়ারী শফিউর রহমান সকাল দশটায় অফিসে রওনা হন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে নবাবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভরত জনতার উপর পুলিশ বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। ওই দিন সন্ধা সাতটায় হাসপাতালে তিনি মারা যান।
গৌরদীপ্ত ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ শফিউর রহমানকে বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ (২০০০) প্রদান করেন। শহীদ শফিউর রহমানকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আব্দুল জব্বার —
ভাষা সৈনিক আবদুল জব্বারের জন্ম ১৩২৬ বাংলা, ২৬ আশ্বিন। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার পাঁচাইর গ্রামে। বাবা আবদুল কাদের। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। পাঠশালায় কিছুদিন পড়াশুনা করার পর আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি বাধ্য হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। যুক্ত হন কৃষিকাজে।

আবদুল জব্বার ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় আসেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কি হয়েছে দেখবার জন্য তিনি রাস্তায় নামেন। ঠিক তখনই পুলিশ গুলি শুরু করে। জব্বার গুলিবিদ্ধ হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জব্বারকে মৃত ঘোষণা করে।
Be First to Comment