নিজস্ব প্রতিনিধি : কলকাতা, ৬ জুলাই, ২০২৩। কোনও কঠিন দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি বোঝেন যে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে, আর সেই সময়ে নিকট জনের ব্যবহারে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেই ব্যক্তি যদি ডাক্তারের কাছে মারসি কিলিং বা স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানান– তাহলে সেটা ঠিক না ভুল! সে ক্ষেত্রে কি করবেন সংশ্লিষ্ট ডাক্তার বাবু! এই প্রশ্ন তুলেছে বেলঘরিয়া থিয়েটার অ্যাকাডেমির সাম্প্রতিক প্রযোজনা বিষ।
পাশাপাশি উঠে এসেছে, কেন জীবনের প্রতি যাবতীয় উৎসাহ হারিয়েছেন অজিত বাবু, সেই প্রসঙ্গও।
মা হারা দুই শিশু পুত্রকে বুক দিয়ে আগলে বড় করেছেন অজিত বাবু। দুই পুত্র এখন বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। অজিতবাবু বুকের ক্যানসার নিয়ে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। খবর পেয়ে ছেলেরা এসে উপস্থিত হয়। বাবাকে তারা সুচিকিৎসার জন্য আমেরিকা নিয়ে যেতে চায়। বিনিময়ে বাবার কাছে তাদের সামান্য আবদার, কলকাতার বাড়িটা তাদের নামে লিখে দিতে হবে বাবাকে।
তারা বাড়ি বিক্রি করে প্রোমোটারের কাছ থেকে মোটা টাকা নেবে আর সেই টাকায় হবে তাদের বাবার চিকিৎসা। এমন সুযোগ্য সন্তানদের আসল উদ্দেশ্য সহজে বুঝতে পারেন অজিত বাবু। তিনি অপদার্থ পুত্রদের পিতার আবেগ দূরে সরিয়ে রেখে যথার্থ মানুষের কর্তব্য পালন করেন। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন তার পুত্রদের। বাড়িটি লিখে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে, যেখানে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। এখানেই সার্থকতা বেলঘরিয়া থিয়েটার অ্যাকাডেমির এই নাটকটির।
নাটকটির রচনাকার এবং পরিচালক ও অভিনেতা অমিতাভ ভট্টাচার্য পেশায় নিজেই একজন ক্যানসার চিকিৎসক এবং এমন ঘটনা ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় তার নিজের চোখেই দেখা। কাজেই নাটকের রয়েছে চূড়ান্ত বাস্তবতার ছোঁয়া। যে জন্যই এই নাটক ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে এবং কোনও কোনও সময় হাসিয়েছেও। আর এই সব কিছুর পিছনে আছে মর্মস্পর্শী সংলাপ এবং পরিচালক অমিতাভর মুন্সিয়ানা। প্রৌঢ় ডাক্তার রায় এবং বৃদ্ধ ক্যানসার রোগী অজিত বাবু, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী দুটি চরিত্রে অমিতাভর অভিনয় এই নাটকের প্রধান সম্পদ।
বড় সুন্দর গেয়েছেন তিনি তালাত মামুদের ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’ এবং অখিল বন্ধু ঘোষের ‘পিয়াল শাখার ফাঁকে’র অংশবিশেষ। নাটকের নেপথ্যে বিভিন্ন কালজয়ী গানের অসাধারণ প্রয়োগ করেছেন সংগীত পরিচালক গৌতম চক্রবর্তী এবং আবহ নির্দেশক প্রয়াত মানিক দত্ত। এবং সেগুলো সুন্দর প্রয়োগ করেছেন আবহ প্রক্ষেপক অমিত ঘোষ। মঞ্চসজ্জায় একটি হাসপাতালের কেবিন এবং ডক্টরস রুম চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন সোমনাথ হাজরা। আলোক প্রক্ষেপনে বাবলু চৌধুরী এবং রূপসজ্জায় বিশ্বনাথ মাইতি নাটকের মুড অনুযায়ী কাজ করেছেন। নাটকের নেপথ্যে প্রখ্যাত অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বেগম আক্তারের একটি ঠুংরি শুনে চমকে উঠতে হয়!
অভিনয়ে সবাই ছিলেন কম বেশি উজ্জ্বল। ধৃতিকণা ভট্টাচার্য, শিবনাথ আচার্য, অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়, সোমা চক্রবর্তী রাকেশ পাল, শক্তি প্রসাদ নিয়োগী, বাসুদেব পাল, প্রদীপ মন্ডল, পায়েল রায়, রীনা শীল–সবাই মিলে এই নাটকে পূর্ণতার মালা গেঁথেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘কুড়ি বছর পরে’ নেপথ্যে আবৃত্তি করেছেন দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এই নাটকের প্রচার অংকন করেছেন সোমনাথ মন্ডল।
একজন ডাক্তারের নেতৃত্বে এমন মানবিক ডাক্তারি বিষয় নিয়ে এই নাটক দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সমাজটা এখনো পুরো বিষিয়ে যায়নি। অন্ধকারে আলোর আভাসও দেখা যাচ্ছে। গত ২৮ জুন সন্ধ্যায় গিরিশ মঞ্চে এই নাটকের অভিনয়ে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়।
দর্শকাসনে বসে তিনি পুরো নাটকটি দেখলেন এবং তারপর মঞ্চে উঠে দু-চার কথা বললেন।
Be First to Comment