*’পি আর পি’- পদ্ধতিতে টাক পড়ে যাওয়া অংশে পুনরায় চুল গজানো সম্ভব।**
সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা, ১১ জুন ২০২২। চুল ত্বকের বহিঃস্তরে অবস্থিত ফলিকল থেকে উৎপন্ন সরু লম্বা সুতোর মতো প্রোটিন তন্তু। চুলের প্রধান উপাদান হচ্ছে কেরাটিন। চুল হল মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক। তাই ঘন, কালো চুল প্রতিটি মানুষই আশা করে। কিন্তু আজকাল নানা কারনে খুব অল্প বয়সেই নারী- পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেরই চুল ঝরে পড়ার প্রবনতা দেখা দিয়েছে। এমনও হচ্ছে ছেলেদের তিরিশের আগেই মাথায় চকচকে টাক উঁকি দিচ্ছে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে চুল এতটাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে যে সেই চুলে কোন স্টাইল বা প্রসাধন করা সম্ভবপর হয় না। প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০ টি চুল পড়া স্বাভাবিক বলা যেতে পারে কিন্তু তার বেশি হলেই ধরে নিতে হবে চুলের কোন সমস্যা আছে। ১২৫ টির উপর চুল যদি নিয়মিত পড়তে শুরু করে সেক্ষেত্রে কিছুদিন লক্ষ্য করার পরই অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া আবশ্যিক। কারন এই চুল ঝরে পড়ার একাধিক কারন থাকতে পারে সেটা ত্বকের বিশেষজ্ঞ ছাড়া সঠিক কারন নির্ধারণ সম্ভবপর নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চুল পড়ার সব থেকে বড়ো কারণ বংশগত হতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় চুল পড়ে টাকের সৃষ্টি হয়। এটিকে অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া বলে। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণত পুরুষদের মাথার সামনের দিকে এবং মাঝখানে টাক তৈরি হয়। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে সিঁথি বরাবর প্রথমে চুল উঠতে শুরু করে পরবর্তীকালে মাথার ধার বরাবর চুল উঠতে থাকে। হরমোনজনিত কারনেও মাথার চুল ঝরে পড়তে পারে। অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন বিশেষত ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন( Dihydrotestosterone সংক্ষেপে (DHT) পুরুষদের মাথায় টাক এবং মহিলাদের চুল ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। তবে বিশেষজ্ঞরা চুল পড়ার আরো বেশ কিছু কারনের কথা বলেছেন। সেগুলো হল- (১) অত্যাধিক মানসিক চাপের কারনে চুল ঝরে পড়তে পারে। (২) বেশ কিছু অসুখেও চুল পড়ে যেতে পারে। (৩) ছত্রাক সংক্রমণের কারনে চুল ঝরে পড়ে। (৪) অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ধূমপান, এবং ওজন কমানোর জন্য অতিরিক্ত ডায়েট করাও চুল পড়ার বড় কারন। (৫) চুলের প্রসাধন বা স্টাইল চুল ঝরে পড়ার কারন হতে পারে। (৬) বেশ কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চুল ঝরে পড়ার সমস্যা লক্ষ্য করা যায়।
এই ধরনের নানা সমস্যার ফলে চুল পড়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসা দ্বারা পুনরায় চুল গজানো সম্ভব আবার কিছু ক্ষেত্রে সম্ভবপর নয়। চুলের এই নানান সমস্যা এবং তার সমাধানের উপায় জানতে বিশিষ্ট ত্বক বিশেষজ্ঞ সঞ্চয়িতা বালার মতামত তুলে ধরা হল।সঞ্চয়িতা জানালেন, ” পুরুষদের মাথায় টাক পড়া আগে একটু বয়স বাড়ার পরই দেখা যেত, আর মহিলাদের সিঁথির পাশ দিয়ে চুল হালকা হয়ে যাওয়া সাধারণত তিরিশেই পরই নজরে আসতো। কিন্তু এখন মানুষের সবকিছুই খুব তাড়াতাড়ি ঘটছে। এটার পেছনে অনেক কারনই থাকতে পারে, যেমন- পরিবেশ দূষণ, মানুষের অনিয়মিত জীবন যাপন, অত্যাধিক মানসিক চাপ। এই মুহূর্তে অল্প বয়সি ছেলেমেয়েরা তাদের কেরিয়ার নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকে, এই অতি মাত্রায় চিন্তা তাদের শারীরিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। চুল ওঠার সমস্যাটি তাদের এই অধিক চিন্তারই একটা ফলশ্রুতি মনে হয়। তবে আরেকটি ব্যাপার হল অনেকে চুল উঠতে শুরু করলে সেটা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ে তাতে চুল ঝরার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। তাই আমরা প্রাথমিক ভাবেই এই চুল পড়া নিয়ে টেনশন করতে বারন করি। চুল পড়ার পেছনে খাদ্যাভ্যাসের একটা বড় ভূমিকা আছে। আজকাল অল্প বয়সিদের বাইরের খাবার খাওয়ার দিকে ভীষণ ঝোঁক দেখা যায়। কিন্তু ফাস্ট ফুড একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয় ,তাই এই সব খাবার বেশি খেলে চুলের ওপরও তার প্রভাব পড়ে।
তবে ছেলেদের অল্প বয়সে টাক পড়ে যাওয়ার পেছনে হরমোনজনিত একটি কারনও আছে, তাকে বলি অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া। এটা ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে। পরিবারের কারো যদি এধরনের সমস্যা থেকে থাকে সেক্ষেত্রে সেই পরিবারের অন্যদের মধ্যেও এই সমস্যার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়। এছাড়াও আরো কিছু শারীরিক সমস্যাও চুল পড়ার সঙ্গে জড়িত। আমরা চুল ঝরে পড়াকে অ্যালোপেশিয়া বলি। এর আবার আলাদা আলাদা ভাগ আছে। চুলের নানা ধরনের যে সমস্যা আছে তার সঠিক ভাবে চিকিৎসা করালে অনেক ক্ষেত্রেই সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারজন্য দীর্ঘদিন ধৈর্য্য ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। সেটা অনেকেই পারেন না বলে সে রকম ফল পান না। তবে সঠিক চিকিৎসা হলে নতুন চুল গজানো অবশ্যই সম্ভব। এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, ‘পি আর পি’ বলে একধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে টাক পড়ে যাওয়া অংশে নতুন চুল গজাচ্ছে। এগুলোর রেজাল্ট কিন্তু আজীবনের জন্য নয়, পরবর্তীকালে আরেকবারও এই ট্রিটমেন্ট করাতে হতে পারে।
থাইরয়েডের জন্য অনেক সময় চুল পড়ে। থাইরয়েডের নিয়মিত ওষুধ খেলে তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ফলেও চুল ঝরে পড়ে। সঠিক পুষ্টির অভাবও চুল পড়ার অন্যতম কারন। শরীরে আয়রন, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, ভিটামিন এ, ম্যাগনেসিয়াম- এগুলোর অভাব ঘটলে চুল ঝরে যায়। আমরা তাই পেশেন্টদের এই দিকগুলো দেখে নিই। হেয়ার টাইডিং চুলের জন্য খুব ক্ষতিকর, তাই টাইডিং করেও যাতে চুলের স্বাস্থ্য বজায় থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। আবার অনেকে চুল খুব টেনে বাঁধে, তাতে মাথার সামনের চুল অনেক সময় উঠে গিয়ে ফাঁকা হয়ে যায়। সেকারণে চুল বাঁধার সময় এই দিকটা মাথায় রাখতে হবে। তবে আরেকটি বিশেষ দিক হল টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম, এটা হয় সাধারণত খুব মানসিক চাপ ও শারীরিক চাপের ক্ষেত্রে । যেমন- কারো পরিবারের যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটল বা কারো কোন বড় অপারেশন হল বা বিশেষ কোন অসুখ হল – এসব ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার বেশ কিছুদিন বাদে খুব চুল ঝরে যাওয়ার ঘটনা দেখা যায়। বাচ্চা হওয়ার পরেও অনেক মহিলার মধ্যেই এই প্রবনতা দেখা যায়, এটা যদিও খুব সাধারণ একটা ঘটনা। এই টেলোজেন ইফ্লুভিয়ামের ফলে যে চুল ঝরার ঘটনা ঘটে সেটা পরবর্তীকালে ঠিক হয়ে যায়। তবে কখনো ওষুধেরও প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় যৌন সংক্রান্ত সমস্যার কারনেও চুল ঝরার ঘটনা ঘটে, সে সব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অনেকের আবার ধারনা যে চুলে তেল না দেওয়ার ফলে চুল উঠে যায় , এটা কিন্তু একেবারেই ভুল ধারনা। আমাদের মতে মাথায় তেল না দেওয়াই ভাল, যদি প্রয়োজন হয় তবে স্ক্যাল্প বাদ দিয়ে তেল দেওয়া উচিত। অতিরিক্ত ধূমপান স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে চুল ঝরে পড়ার কারন হতে পারে। তাই পুরুষ- মহিলা উভয়কেই এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। অল্প বয়সী মেয়েদের পিসিওডির কারনেও অতিরিক্ত চুল ঝরে পড়তে পারে তাই তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
চুল ঝরা রোধ করতে কি কি করতে হবে সে ব্যাপারে সঞ্চয়িতা জানালেন,
(১) খাদ্যাভ্যাসের দিকে সঠিক ভাবে নজর দেওয়া। যেমন- সময়মত স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাওয়া, বাইরের খাবার এড়িয়ে চলা, পর্যাপ্ত পরিমাণ সবজি এবং ফল খাওয়া।
(২) অতিরিক্ত চুল ঝরলে ধূমপান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
(৩) যাদের প্রতিদিন বেরতে হয়, তাদের সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন শ্যাম্পু করতে হবে।
(৪) সঠিক চিরুনি ব্যবহার করতে হবে।
(৫) চুলের কোন বিশেষ সমস্যা দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
(৬) যাদের হরমোনজনিত বা থাইরয়েডের সমস্যা আছে তাদের নিয়মিত চেকআপের প্রয়োজন আছে কারন ওইসব সমস্যার সঙ্গে চুল পড়ার সমস্যা জড়িয়ে আছে।
(৭) নিয়মিত দুই থেকে তিন বার চুল ব্রাশ করতে হবে।
(৮) খুশকি থাকলে একেবারেই মাথায় তেল ব্যবহার করা যাবে না।
(৯) চিন্তামুক্ত থাকা।
চুল সমস্যা সম্পর্কে রূপ বিশেষজ্ঞ যশোশ্রী রেহমান বলেন, ” অসময়ে চুল ঝরার একটি অন্যতম কারন হল পরিবেশ দূষণ। চারপাশের এত দূষণ আমাদের চুলের ওপর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া আমাদের লাইফস্টাইল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের সময়ের ও একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেকেই মাঝরাত অবধি পড়াশোনা ছাড়াও ইন্টারনেটে অনেক বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখে। এই রাত জাগাও চুল ওঠার অন্যতম কারন। তবে আমি রূপ বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি বিশেষ দিকের ওপর আলোকপাত করছি সেটা হল আজকাল কম- বেশি বহু মহিলা এবং পুরুষও চুলের স্টাইলের বা প্রসাধনের দিকে ঝোঁকেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই বাড়িতে বসেই চুলের স্টাইলের জন্য এমন কিছু প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন যেটা তার স্ক্যাল্পের জন্য অনুকূল কিনা তা বিচার করেন না। তাছাড়া আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চুলের রঙই হোক বা হিট দেওয়াই হোক – যাই করা হোক না কেন, সবেরই কিছু বিশেষ নিয়ম থাকে। অনেকেই ঠিকমত কোন কিছু না জেনেই সে জিনিসগুলো চুলের ওপর প্রয়োগ করেন, তাতে চুলের খুব ক্ষতি হয়ে যায়। তাই শেষে একথাই বলবো, চুলের স্টাইল করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে। কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া চুলের স্টাইলের জন্য কোন কিছু প্রয়োগ করা ঠিক নয়।”
তাই সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক চুলকে আজীবন ধরে রাখতে গেলে আমাদের অনেক কিছুই মাথায় রেখে রোজকার জীবনে পা ফেলতে হবে।
Be First to Comment