জন্মদিনে স্মরণঃ ঋ ত্বি ক কু মা র ঘ ট ক
“ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তার সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।”
[ সত্যজিৎ রায় ]
বাবলু ভট্টাচার্য : ব্যক্তি ঋত্বিক ঘটককে কখনোই কেবল চলচ্চিত্রকার পরিচয়ে আটকে রাখা যায় না। এই উপমহাদেশের শিল্পাঙ্গনে ঋত্বিক ঘটকের নামটি এমন এক শিল্পীর যিনি ‘শিল্পের জন্যই শিল্প (Art for arts sake)— এই তত্ত্বকথায় বিশ্বাস না করে শিল্পকে ব্যবহার করেছেন মানবতার স্বার্থে কাজে লাগানোর এক মাধ্যম হিসেবে।
একজন ঋত্বিক ঘটককে আমরা তাই বারবার দেখতে পাই গল্পকার, নাট্যকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকারসহ দৃশ্য শিল্পের প্রায় সব রূপেই। গণমানুষের কাছে নিজের বার্তা পৌঁছে দিতে তাঁর সৃজনশীলতার পক্ষে সম্ভব এমন সবগুলো মাধ্যমেই কাজ করে গেছেন তিনি। শিল্পের এই ‘বিদ্রোহী শিশু’ জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও খুঁজে গেছেন শিল্পের নবতম মাধ্যমকে— যা দিয়ে মানুষের আরও কাছে পৌঁছানো যায়।
রাজশাহীতে কলেজে পড়ার সময় থেকেই ঋত্বিক নাটক করা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে কে.এন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েও নাটকের নেশাতেই পড়ালেখা ছেড়ে দেন।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তিনি নাটক লেখার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন, নির্দেশনাও দিয়েছেন। তার নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে— ‘জ্বালা’, ‘অফিসার’, ‘দলিল’, ‘সাঁকো’ এবং ‘সেই মেয়ে’।
ঋত্বিকের লেখালেখির শুরু ১৯৪৭ সাল অর্থাৎ দেশভাগের সময় থেকেই। গল্প ও কবিতা লিখেছেন অনেকগুলোই। সেগুলো সে সময়ের পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক বিমল রায়ের সহকারী হিসেবে সেলুলয়েডের দুনিয়ায় প্রবেশ ঘটে ঋত্বিকের।
ঋত্বিকের প্রথম সৃষ্টি ‘নাগরিক’। ১৯৫২-৫৩ সালে ছবিটি তৈরি করেন তিনি। তবে তাঁর জীবদ্দশায় ছবিটি মুক্তি পায়নি। এরপর ঋত্বিক তৈরি করেন দুটি হিন্দি তথ্যচিত্র ‘দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিস’ (১৯৫৫) এবং ‘প্লেসেস অফ হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার’ (১৯৫৫)।
১৯৫৭ সালে তৈরি হয় ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’। একজন ড্রাইভার এবং তার গাড়িকে নিয়ে তৈরি করা এই ছবিটিকে তিনি ফ্যান্টাস্টিক রিয়ালিজম ঘরানার বলেছেন। ছবির নায়ক ড্রাইভার এবং নায়িকা তার গাড়ি— অযান্ত্রিকের গল্প এগিয়ে গেছে এভাবেই। সেসময় পুরো ভারতজুড়েই এক অন্যরকম আলোড়ন তুলেছিল ছবিটি।
২১ বছর বয়সে দেশভাগের কারণে ঋত্বিক ঘটক পরিবারের সঙ্গে পূর্ব বাংলা ছাড়তে বাধ্য হন। দাঙ্গা, মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ তাঁকে বিপর্যস্ত করেছে। সম্ভবত সেই কারণেই সমকালীন বাস্তবতাই হয়ে ওঠে তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়। অতীত বা ভবিষ্যত নিয়ে ফ্যান্টাসি সেখানে অনুপস্থিত।
১৯৬৫ সালে ‘সুবর্ণরেখা’ মুক্তির পর ৮ বছরের বিরতি নেন ঋত্বিক। এ সময় সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ অনেকগুলো তথ্যচিত্রের কাজ করলেও, পূর্ণাঙ্গ কাহিনিচিত্রে হাত দেন ১৯৭২ সালে।
সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে উড়ে আসেন তাঁর অন্যতম বিখ্যাত ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তৈরির উদ্দেশ্যে। অদ্বৈত মল্লবর্মনের ধ্রুপদ উপন্যাস থেকে তৈরি করা এই ছবি একদিক থেকে যেমন পেয়েছিল বিপুল প্রশংসা, অন্যদিকে প্রচণ্ড সমালোচিতও হয়েছিল।
দর্শকরা ছবিটির পক্ষে খুব ভালো সাড়া না দিলেও, বাংলা ছবির ভাণ্ডারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এক অমূল্য রত্নখণ্ডই।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই ছবির কথক যেন তিনি নিজেই। নিজের বক্তব্য তিনি নিজেই কাহিনির ছলে বলে গেছেন এই ছবিতে। ছবিটিতে নিজের রাজনৈতিক মতবাদকেও দ্বিধাহীনভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে এই ছবিতে তুলে ধরেছেন তিনি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের সৃজনশীলতা এবং জীবনযুদ্ধের অনেক কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দু’জনই ছিলেন শিল্পসৃষ্টিতে একনিষ্ঠ। দু’জনই জীবনের একটা পর্যায়ে অ্যালকোহালিক হয়ে পড়েন এবং পরবর্তী জীবনে মানসিক রোগে আক্রান্ত হন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিস্টিরিয়া ছিল। ঋত্বিকের সহধর্মিনী শ্রীমতি সুরমা ঘটকের এক লেখায় জানতে পারা যায়, ঋত্বিকের সিজোফ্রোনিয়া ছিল।
জীবদ্দশাতেই চলচ্চিত্রে নিজের অবদানের জন্য ঋত্বিক অর্জন করেছেন বহু সম্মাননা। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী উপাধি।
ঋত্বিক কেবল এই উপমহাদেশের একজন মহান শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ শিল্প শিক্ষকও। ১৯৬৩ সালে ভারতের পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে দু’বছর কাজ করেছেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন আরও ৩ মাস। ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মণি কাউল, কুমার সাহানি এবং প্রসিদ্ধ আলোকচিত্রী কে কে মহাজন তাঁরই ছাত্র।
১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
ঋত্বিক ঘটক ১৯২৫ সালের আজকের দিনে (৪ নভেম্বর) ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment