স্মরণঃ উ পে ন্দ্র কি শো র রা য় চৌ ধু রী
বাবলু ভট্টাচার্য : উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। জন্ম ১৮৬৩ সালের ১০ মে। ময়মনসিংহের অজ-পাড়াগাঁ মসুয়া গ্রামে জন্ম হলেও বাল্য-কৈশোরের পর তার জীবন কেটেছে কলকাতাতেই।
উপেন্দ্রকিশোরকে বলা যায় ভারতবর্ষে শিশুতোষ রচনার পথিকৃৎ, পুরাণ ও লোককাহিনিকে শিশুদের উপযোগী করে রচনার ক্ষেত্রে এখনো তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘টুনটুনির বই’ ছাড়াও ‘ছেলেদের রামায়ণ’, ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘গল্পমালা’ (গুপী গাইন বাঘা বাইনসহ)-এর আবেদন এখনো অম্লান।
তবে শিশু-কিশোরদের জন্য উপেন্দ্রকিশোরের সবচেয়ে বড় অবদান নিশ্চয়ই ছোটদের পত্রিকা ‘সন্দেশ’। ১৯১৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে থেমে থেমে হলেও সন্দেশ-এর প্রকাশ এখনো অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তীকালে সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় আর লীলা মজুমদারের পরিচালনা ও সম্পাদনায়, মুদ্রণ ও অলংকরণের সৌকর্যে সন্দেশ হয়ে উঠেছে এক কিংবদন্তি।
তিনি ভারতবর্ষে হাফটোন ব্লকের প্রবর্তন করেন এবং গবেষণার মাধ্যমে এর প্রভূত উন্নতি ঘটান। সম্পূর্ণ দেশীয় উপাদানে গবেষণা করে উপেন্দ্রকিশোর রঙিন মুদ্রণের নানা প্রকার ডায়াফর্ম যন্ত্র, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডুয়োটাইপ ও টিন্ট প্রসেস পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নাম যুক্ত করে রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার ও রে-টিন্ট সিস্টেম নামকরণ করা হয়।
সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত হলেও চিত্রাঙ্কনে তাঁর নৈপুণ্য ছিল অসাধারণ। মূলত নিজ রচনার অলংকরণের জন্য অঙ্কনের চর্চা করলেও তেলরং ও জলরং মাধ্যমেও ছবি এঁকেছেন তিনি। টুনটুনির বই গ্রন্থে তাঁর অলংকরণকে ভারতে শিশুতোষ গ্রন্থ অলংকরণের পথিকৃৎ ও আদর্শ গণ্য করা যায়।
সংগীতজগতেও উপেন্দ্রকিশোর আপন প্রতিভায় ভাস্বর। ব্রাহ্মসমাজের একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সংগীত রচনা ও সুর সৃষ্টি এবং সংগীত বিষয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করলেও উপেন্দ্রকিশোরের মূল আকর্ষণ ছিল বাদ্যযন্দ্র। তিনি বাঁশি, পাখোয়াজ ও হারমোনিয়াম বাজানোয় ছিলেন দক্ষ, তবে বেহালাবাদক হিসেবে তৎকালীন কলকাতায় তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
উপেন্দ্রকিশোর একদিকে ছিলেন একনিষ্ঠ ধার্মিক ও অধ্যাত্মবাদী, অন্যদিকে তাঁর মন ছিল প্রবলভাবে অনুসন্ধিৎসু ও বিজ্ঞানমনস্ক। ভূমণ্ডল ও তার জীবজগৎ এবং মহাবিশ্বের যাবতীয় রহস্য বিষয়ে তাঁর ছিল অপার কৌতূহল এবং এসব বিষয়ে উত্তর খুঁজেছেন তিনি যুক্তি ও প্রমাণের ভেতরে, অধ্যাত্মবাদে নয়।
ভেবে অবাক হতে হয়, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রবল আধিপত্য ও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত নৈকট্য সত্ত্বেও উপেন্দ্রকিশোরের লেখায় রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রভাবই নেই, তাঁর সৃজনজগৎ একেবারেই ভিন্ন মসলায় গড়া।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাঙালিসমাজের এক শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা, যে প্রতিভার ঝলক একটি সময়ে বিশ্ব-বিজ্ঞানের জগতকে আলোকিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর এত বহুমুখী প্রতিভার মানুষ বাঙালিসমাজে আর জন্মায়নি।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি ১৯১৫ সালের আজকের দিনে (২০ ডিসেম্বর) পরলোক গমন করেন।
Be First to Comment