জন্মদিনে স্মরণঃ উ ত্ত ম কু মা র
বাবলু ভট্টাচার্য : শুরুর সেই লড়াইটা ছিল ভয়ঙ্কর। ফ্লপ এবং ফ্লপ। হাত থেকে কনট্রাক্টের কাগজ ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রযোজক। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন— ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার চেহারাটা নায়কোচিত নয়’। তুলনাটা চলে আসত প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে।
ভাগ্যিস ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২) বক্স অফিসের মুখ দেখেছিল। না হলে আজকের বাঙালি কোথায় পেত এই উত্তম কুমারকে। উডু উডু অ্যালবাট, বঙ্কিম গ্রিবা, হৃদয়ে তোলপাড় করা হাসি আর অভিনয়ের চূড়ান্ত আধুনিকতা— এগুলোই উত্তমের সাফল্যের তাস।
ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন কলকাতার সাউথ সুবাবরণ মেইন স্কুল থেকে। ভর্তি হন গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। এখানে পড়েন কমার্স নিয়ে। ১৯৪২ সালেই নিদান ব্যানার্জীর কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন।
১৯৪৪ সালে পৌর কমিশনারস অফিসে খিদিরপুর ডকে ক্যাশিয়ারের চাকরি পান, ২ হাজার টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে জমা দিয়ে।
১৯৪৭ সালে প্রথম ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওর ফ্লোরে আসেন উত্তম কুমার। প্রথম অভিনীত ছবি ‘মায়াডোর’ (হিন্দি)। নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় ‘কামনা’ ছবিতে (১৯৪৯)। নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। ‘কামনা’ মুক্তি পাওয়ার পর এটি ফ্লপ করল।
কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় থাকতেন উত্তম কুমার। কাছাকাছি পাড়ায় সেকালের রূপবান নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য, পুরনো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, চরিত্রাভিনেতা ইন্দু মুখার্জি বসবাস করতেন। তাদের কাজ দেখে শিখেছেন উত্তম কুমার।
আর তাঁর সঙ্গে অবচেতন মনে ছিল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস, জ্যোতি প্রকাশ, অসিতবরণ ও রবীন মজুমদারের মতো রোমান্টিক সব নায়কের রূপালি পর্দায় দেখার অদৃশ্য শিহরণ। সে জন্য তিনি ফিল্মে নায়ক হতে পেরেছিলেন।
অভিনয়ের চেয়েও তখন তাঁর বড় মূলধন ছিল চেহারা। অথচ উত্তম কুমার প্রথম দিকের কোনো ছবিতেই নায়কের ভূমিকা পাননি। শুধু মুখ দেখানো ছাড়া আর কোনো অস্তিত্বই ছিল না সেখানে তাঁর।
সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত, বরং বলা যায় অনুগ্রহের পাত্র হয়েই মাত্র উপস্থিত থেকেছিলেন। ‘মায়াডোর’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘কামনা’, ‘মর্যাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘নষ্ট নীড়’, ‘সঞ্জীবনী’ প্রভৃতি ছবিতে উত্তম কুমার ছিলেন। এর মধ্যে একটি ছবিও ব্যবসাসফল হয়নি। ফলে উত্তম কুমার দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন।
১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি দিয়েই উত্তম কুমারের জয়যাত্রা শুরু। নায়িকা সুচিত্রা সেন। প্রায় ম্যাজিকের মতো ফল পাওয়া গেল ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। বাংলা ছবিতে যে ভাটার টান অনুভব করা যাচ্ছিল, সেই স্তিমিত জলে সহসা আবেগ সঞ্চার করল ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটি।
বাংলা ছবিতে এলো গ্ল্যামার, দর্শকদের ভাল লাগার সঙ্গে যুক্ত হল মুগ্ধতা। নায়ক থেকে মহানায়কের শীর্ষ আসনটিতে উত্তরণের সঠিক যাত্রারম্ভ হল এই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে।
বাঙালি দর্শক সেদিন তাদের আইডিয়াল একজন রোমান্টিক হিরোকে খুঁজে পেলেন উত্তম কুমারের মধ্যে— যার বিকল্প তাঁর জীবদ্দশায় আর আসেনি। নায়ককে ঘিরে যে মোহ বিস্তার, যে গুঞ্জরণ, যে কৌতূহল সবই শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালের সেই সন্ধিক্ষণ থেকে।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রায় মধ্যভাগ থেকে উত্তম কুমার ক্রমেই দর্শক, প্রযোজক, পরিবেশক এবং পরিচালকদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে লাগলেন। এভাবেই বক্স অফিসের নিশ্চিত গ্যারান্টিও হয়ে উঠলেন তিনি। তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম নায়কই নন, চরিত্রাভিনেতাও।
বহু বাংলা ছবিকে ভরাডুবি থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছেন শুধু উত্তম কুমার। শুধু প্রণয়ী নায়কের ভূমিকাতেই তিনি স্থিত থাকেননি, তিনি মদ্যপ জমিদার থেকে ছিঁচকে চোর—বহু ভূমিকাতেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন চরিত্রের মাপে।
সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে সুদর্শন পুরুষ অথবা রোমান্টিকতার সার্থক উদাহরণ ছিলেন উত্তম কুমার। নায়ক শব্দের আগে ‘মহা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে। এটার কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। জনসাধারণের ভালোবাসা আর মুগ্ধতা থেকেই এই শব্দটি জন্ম নিয়েছিল। ক্রমেই উত্তম কুমারের নামের পাশে এই বিশেষণটি স্থায়ী হয়ে গেল।
১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ লিখেছিলেন উত্তম কুমারকে ভেবেই। এভাবে বাংলা সাহিত্যেও অনেক গল্প এবং উপন্যাস লেখা হয়েছে উত্তম কুমারের কথা মনে রেখেই।
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো : ‘পথে হলো দেরী’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শহরের ইতিকথা’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ প্রভৃতি।
উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের আজকের দিনে (৩ সেপ্টেম্বর) কলকাতার অহরিটোলায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment