জন্মদিনে স্মরণঃ আ ল্লা মা ই ক বা ল
“ওঠো দুনিয়ার গরীব ভুখারে জাগিয়ে দাও।
ধনীদের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও॥
কিষাণ-মজুর পায়না যে মাঠে শ্রমের ফল।
সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও…”
——- কবি আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল
বাবলু ভট্টাচার্য : আলাম্মা ইকবাল। ইউরোপে পরিচিত Poet of The East হিসেবে। তার লেখা পরবর্তী প্রজন্মের হৃদয়ে দিয়েছে বিপ্লবের শক্তি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় দিয়েছে নতুন মাত্রা। আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইসলাম চিন্তকদের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার পেছনে তার বাক্য অনুপ্রেরণার মতো। পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক পিতা। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পেছনেও তার চিন্তা।
নুর মুহম্মদ এবং ইমাম বিবি’র সন্তান ইকবাল। সেই ছেলেটা বড় হতে থাকে। বাল্যকাল অতিবাহিত হয় বিখ্যাত পণ্ডিত মীর হাসানের সাহচার্যে। উর্দু, আরবি ও ফারসিতে দক্ষতা আসে। বসতে শুরু করে কবিতার বৈঠকে।
শিয়ালকোট থেকে এফ. এ পাশ করে ১৮৯৫ সালে লাহোর গেলেন তরুণ ইকবাল। লাহোর সরকারি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৯৯ সালে দর্শনে এম. এ ডিগ্রি লাভ করলেন। চলতে থাকে কবিতা চর্চা। লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজ এবং পরে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন ৬ বছর।
১৯০৫ সালে পাড়ি জমান ইউরোপে। এই আবহাওয়া পরিবর্তন তাকে পুরোপুরি বদলে দিল। ম্যাকটাগার্ড এবং জেমস্ ওয়ার্ডের মতো দার্শনিকদের কাছে থেকে নেন দর্শনের পাঠ। ইতোমধ্যে লন্ডন থেকে করেন ব্যারেস্টারি।
১৯০৮ সালে ফিরে আসেন দেশে। লাহোর সরকারি কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ধীরে ধীরে চাকুরি ইস্তফা দিয়ে পুরো দমে শুরু করেন আইন ব্যবসা। কারণ, তাতে মুক্তভাবে চিন্তা করার অবকাশ থাকে। কবিতায় আন্দোলন তোলে তরুণ রক্তে। কবিত্বকে ছাপিয়ে যায় দর্শন। কখনো কবিতায়, কখনো বক্তব্যে প্রকাশ করতে থাকেন মৌলিক দার্শনিক চিন্তা।
ছন্দবদ্ধ ভাষায় মনের ঐকান্তিক আবেগকে সামনে তুলে আনার সময় ইকবাল কবি। অবশ্য কবিতার মধ্যেই স্ফুরিত হয়েছে তার দর্শন।
ইকবালের চিন্তার মূল প্রেরণা ইসলামের প্রাণশক্তি। দার্শনিক নিৎশে এবং বার্গসৌঁ- এর প্রভাব থাকলেও জালাল উদ্দিন রুমিই তার ভাবগুরু। ছিল ইসলামি দর্শন এবং ইউরোপীয় চিন্তার মধ্যে সেঁতু বন্ধনের প্রয়াস। কোরান হাদিসে বিধৃত কর্মবাদ এবং পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে গভীর ঐক্য উপলব্ধি করেছেন তিনি।
ইকবালের মতে, জগতে সকল পরিবর্তনের মূলগত সত্তা প্রাণ প্রবাহ; যা প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই প্রবাহিত। মানুষের মধ্যে প্রাণ প্রবাহের প্রকাশ হলো ইচ্ছা। সমস্ত সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মধ্যেই বেঁচে থাকার ইচ্ছা দেখা যায়। মানুষ শুধু বেঁচে থাকতে চায় না; জীবনকে উন্নত করার জন্য সংগ্রাম করে। ধর্ম, কলা, বিজ্ঞান এবং নীতি জীবনকে শক্তিশালী করার উপায় স্বরূপ।
ইকবালের ভাষ্যে, পরম খুদির সাথে সসীম খুদির সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব। তবে, পরম খুদির মধ্যে লুপ্ত হওয়া সসীম খুদির লক্ষ্য না। পরম খুদির মধ্যে সসীম খুদির বিলুপ্তির আরেক অর্থ খুদির বিনাশ। খুদির বিলুপ্তি ইসলামের মূল শিক্ষার বিরোধী। খুদির বিনাশ সাধিত হওয়ার মানে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ক্রিয়াবলির কোন অর্থ না থাকা। জীবন অর্থহীন না।
কবিতা রচনার গোড়ার দিকে ইকবালের ঝোঁক ছিল ফারসি ভাষা। কবিতায় রচিত বারো হাজার পঙক্তির মধ্যে প্রায় সাত হাজারই ফারসি। ১৯১৫ সালের দিকে প্রকাশিত হয় ‘আসরার-ই খুদি’; আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বিখ্যাত খুদিতত্ত্ব। সমালোচকেরা একে তার শ্রেষ্ঠ রচনা বলে তকমা দেন। এর সূত্র ধরে লেখা হয়েছে পরবর্তী গ্রন্থ ‘রুমুজে বেখুদি’।
১৯২৭ সালে ‘যাবুরে আজম’, ১৯৩২ সালে ‘জাভেদ নামা’ এবং ১৯৩৬ সালে ‘পাস চিহ বাআদ কারদ আয় আক্বওয়ামে শারকি মাআ মুসাফির’।
ইকবাল ১৯০৮ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে করা থিসিস Development of Metaphysics in Persia প্রকাশিত হয়; যা মুসলিম ও পারসিক দর্শনচর্চার ইতিহাস তুলে ধরেছে। দীর্ঘদিনের সমস্ত দার্শনিক অভিজ্ঞতা নিয়ে শক্তিশালী লেখা The Reconstruction of Religious Thought in Islam মূদ্রিত হয় ১৯৩০ সালে। এছাড়া পাঞ্জাবি ভাষাতেও কিছু কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। ভাষা আর বিষয়বস্তুর এই বৈচিত্র্য ইকবালকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে।
ইকবাল নতুন সমাজ চেয়েছেন; যেখানে ইশকের মধ্য দিয়ে ইনসানিয়াত পূর্ণতা পাবে। সেই দিক থেকে ইকবাল বিপ্লবী। ইসলামের শিক্ষাকে দেখেছেন বৈপ্লবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখিয়েছেন পশ্চিমা অভিজ্ঞতাবাদের সাথে ইসলামের বিরোধ নেই। বরং ইসলাম দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে।
কোরান ইহজগৎ আর পরজগতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মানবজীবনের সর্বোচ্চ মূল্যবোধসমূহের বাস্তব রূপায়ণের নির্দেশনা দেয়। ইকবালের সেই চিন্তাধারা শুধু মুসলিম জাতিকেই উদ্বুদ্ধ করেনি; বিশ্বের প্রগতিশীল মানবমনকেও আন্দোলিত করেছে। আধুনিক মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার যে উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে; তার যুগস্রষ্টা আল্লামা ইকবাল।
১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই ক্ষণজন্মা।
মহাকবি আল্লামা ইকবাল ১৮৭৭ সালের আজকের দিনে (৯ নভেম্বর) অবিভক্ত পাক-ভারত উপমহাদেশের পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment