Press "Enter" to skip to content

আসুন, দুঃখ ভুলে হাসতে শুরু করি। বাঙালির এখন হাসবার পালা শুরু করা যাক। “প্রতিদিন যদি কাঁদিবি তোরা, একদিন নয় হাসিবি আয়।….

Spread the love

জাদুপোনিষদ=( পর্ব – ৭ ) Direct from the Desk of Magician P C SORCAR Junior.
(ডঃ প্রদীপ চন্দ্র সরকার, এমএসসি পিএইচডি)

” হেসেছে , কি ফেঁসেছে ”
================

‌ ‌‌ ক’লকাতায় দ্রষ্টব্য জিনিষ কি কি আছে জানা নেই, তবে এই শহরে , কোন‌ কোন জিনিষ নেই বা আগে ছিলো, এখন দেখতে পাওয়া যায় না, তার একটা সমীক্ষা নাকি একবার নেওয়া হয়েছিলো।‌ নানা ব্যক্তি নানা ভাবে খোঁজ-খবর লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসেন, যে ক’লকাতায় টাকা ঢাললে , পৃথিবীর যে কোনোও জিনিষই পাওয়া যায়। তা সে বাঘের দুধই হোক আর ডাইনোসরের ডিমের ওমলেটের ফসিলই হোক,’ক’লকাতায় পাওয়া যায় না’ , বা ‘ক’লকাতায় দেখা যায় না’, এমন কোনোও জিনিস এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে কেন, কোনোও নীহারিকাতেই নেই।
কথাটা শুনে কিছু ফচকে ছোঁকড়া লাফিয়ে উঠে নাকি, সুর ক’রে বলেছিলো :
— ” ভুল কথা… ভু–ল.., ক’লকাতায় তিনটে জিনিষ নেই। দে-খাও যায় না।”

—কোন কোন জিনিস সেগুলো, শুনি ?

— (১) পাগড়ীধারী সর্দারজি ট্রাম কন্ডাক্টার নেই
(২) কাবুলিওয়ালার কাবুলি বৌ নেই ;
(৩) ম্যাড্রাসি মৃতদেহ নিয়ে শোক যাত্রা হয়না।

সব্বাই এক বাক্যে হেসে মেনে নেন।

ওপরের ‘আখ্যান’-টা, নিছকই একটা রসিকতা। মোটা দাগের বোকা-বোকা রসিকতা। এতে না আছে ঐতিহাসিক ঘরাণা, না আছে তার প্রয়োজনীয়তা,বা, না আছে কোনও কাব্য রস ! তবে আমার মনে হয়, এতে সমাজবিজ্ঞানের চিন্তার খোরাক আছে। সর্দারজি ট্রাম কণ্ডাক্টার সত্যিই দেখা যায় না । এটা বোধহয় ওঁদের জাতীয়তাবাদী চরিত্রের জন্য। ওঁরা এমনিতেই, দেখা যায়, ‘চাকরি করা’ জিনিসটাকে অপছন্দ করেন। বিশেষ ক’রে বিদেশীদের অধীনে। ট্রাম কোম্পানির মালিক, এই সেদিন পর্যন্তও ছিলো ইংল্যান্ড !!! শিখেরা স্বাবলম্বি ভাবে ব্যবসার মাধ্যমে, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ক’রে হ’লেও , নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে ইজ্জত চান। সেজন্যই (হয়তো) ওঁরা কখনও ট্রাম কণ্ডাক্টারি করেন না। ওঁরা ব্যাবসা করতে, গতরে খেটে হাতুড়ি -বাটালি চালিয়ে সৃষ্টিধর্মী কাজ ক’রতে বা সৈনিক হতে পছন্দ করবেন। সেজন্য সর্দারজিদের মধ্যে ট্রাম কণ্ডাক্টারি নেই। “নৈব নৈব চ।” দেখা যায় না। ওটা বিহারীদের জন্য বরাদ্দ।

(২) কাবুলিওয়ালারা পরিযায়ী ব্যাবসাদার। ওঁরা ব্যাবসার কারণে হাত-পা-ঝাড়া হ’য়ে, নির্দায় ভাবে চলা-ফেরা, দৌড়-ঝাপ করতে বাধ্য হন। যেন চলন্ত এক-একটা ‘চিট-ফাণ্ড’ কোম্পানি। সেজন্য তাঁরা পরিবার কে ‘দেশে ‘ রেখে আসেন। সেজন্য বোরখা-চাপা হ’লেও সঙ্গে দেখা যায় না।
খেয়াল ক’রেছেন ?!? ক’লকাতায় কাবুলিওয়ালারা হঠাৎ কেমন ভ্যানিশ হ’য়ে গেছেন। না, তা কিন্তু সত্যি নয়। ওরা সংখ্যায় বরঞ্চ বেড়েছেন। আমরা চিনতে পারছি না। ওঁরা ঢোলা-সালোয়ার কূর্তা ছেড়ে জিনস্-টি শার্ট পড়া শুরু করেছে, তাই চেনা যাচ্ছে না। তবে হিং-সূরমা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ফিরি করাটা উঠেই গেছে।

(৩) দক্ষিণ ভারতীয় মাত্রেই আমরা নাম দিয়েছি ম্যাড্রাসি। এঁরা ক’লকাতায় বাঙালি দের সঙ্গে মিশে গেছেন। চেনার উপায় নেই। সবারই ‘শেষ যাত্রা’ ওই একই ‘স্বর্গ রথে’ চ’ড়ে হয়ে থাকে। সুতরাং আলাদা ক’রে ওঁদের শবানুগমন চেনা দায়।

তবে আমার হিসেবে, দুর্লভ দৃশ্য, যেটা শুধু ক’লকাতায় নয়, পুরো বাঙালি জাতটার মধ্যে থেকে, চ’ষে বুঝেছি, একটা-দুটো হলেও,টিকে আছে। তবে চিন্তা নেই, খুব শিগগিরই আর তাঁরাও থাকবেন না। সেটা হ’লো ‘হাসি-মুখের ভদ্র বাঙালি ‘। বাঙালির মুখের হাসি ফুরিয়ে গেছে। সবার সঙ্গে অহেতুক খ্যাচ-খ্যাচ করাটা আর খোঁচা দিয়ে কথা বলাটা এখন বাঙালি মাত্রেরই জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ব’লে সর্ব-ভারতীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার ইউনেস্কোর স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছি। কথ্য ভাষার অধঃপতন আর কানে লাগছে না। সবাই অধঃপতিত হ’য়েই গেছি। খবরের কাগজে সম্পাদকীয় আর চিঠি-পত্র ছাড়া আর কোথাও বুদ্ধির ছাপ নেই। সর্বত্রই পেইড নিউজের কালো ধ্যাবড়া ছায়া। আমাদের বুদ্ধিমানের বা রুচির মান নিয়ে গর্ব করার আর কিছু নেই।

যে কোনও একটা বাঙালির দোকানে যান। প্রাণ ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চাইবে। দেখবেন দোকানির বিটকেল, গম্ভীর মুখ আর দুর্ব্যবহার যেন আপনার উপস্থিতি তাঁকে ভী–ষ–ণ বিরক্তিতে ফেলেছে। যেন ব’লছেন : হা ঈশ্বর !!!…আবার নড়তে হবে। বেশ, ব’সে ব’সে চুলকোচ্ছিলাম, মানে, ভঙ্গ বঙ্গের কপাল ফাটা জীবনের প্রাপ্য পরম সুখটা বেশ ভোগ করছিলাম, তো, এই হতভাগা ‘ওয়াইফের ব্রাদার’টা এসে তাতে ব্যাঘাত ঘটালো। সেজন্যই যেন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী চাই ?” ‌ —(+)—
বেশ অনেক বছর আগেকার কথা।
চিত্তরঞ্জন আ্যাভেনিউ এর মোড়ে সরকারি খাদির বিরাট দোকানটায় ঢুকেছিলাম পাঞ্জাবী বানাবো, কাপড় কিনতে। শীতকাল। কিছু বয়স্ক ব্যক্তিকে চেয়ারের ওপরেই হাঁটু মুড়ে আলোয়ান গায়ে কুঁচকে ব’সে থাকতে দেখলাম। স্ট্যাচুবৎ স্থির। ভেবেছিলাম আধুনিক ভাস্করদের সৃষ্ট বিভিন্ন আঁতেল মূর্তি । আমি ঢুকতেই একটা কোন থেকে বিরক্ত মাখা প্রশ্নবাণ ছুটে এলো, “কী চাই”!
বয়স্ক মানুষের বিরক্ত, তিক্ষ্ণ কণ্ঠ আমায় আত্মসমর্পণ করিয়ে ছাড়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলি “সিল্কের পাঞ্জাবীর কাপড়।”
–“তা, এদিকে কেন ? এটা লেডিজ সেকশন। ওদিকে যান।
–“সরি। জানতাম না।”
ওপাশের এক আলোয়ান জড়ানো কণ্ঠে বললেন
–“কী চাই ?”
–“পাঞ্জাবীর কাপড়, সিল্কের।”
–“সিল্কের ? তাহলে ওপাশে যান।”
আমি সিল্ক-রুট ধ’রে সেদিকে যাই। ওপাশের টিউব লাইট কয়েকটা টিং-টিং-ক্যাটাং আওয়াজ ক’রে জ্বলে ওঠে। এখানস্থ স্ট্যাচুটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। নড়ে ওঠেন।
–কী চাই?
–পাঞ্জাবীর কাপড়। সিল্কের।
–এখানে স-ব সিল্কের। কোনটা চাই ?
–একটু হালকা রঙের চাই। দেখান।
–এই তো আলমারিতে আপনার চোখের সামনেই রয়েছে। কোনটা পছন্দের বলুন।
–একটু মেলে ধরলে ভালো হয়…
–পছন্দ করুন, সেটা মেলে ধরছি।
আমিও বাঙালি। সম ব্যথী। বলি,”ওই যে ওপরে ওই থানটা রয়েছে, ওটাকে নামান। দেখি চলবে কিনা!
মনে ছিলো না, উনিও হাড় বাঙালি। হাতের সবচেয়ে কাছের একটা কাপড়ের থানকে আমার দিকে ঠেলে বলেন: –“কাপড়টা এই রকম, রং টা ওই রকম।”
বুঝলাম উনি অপরিচিত হলেও আমার আত্মীয়।
সেজন্য বললাম: ” দিয়ে দিন। কতো দাম ?”
উনি দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, “কতোটা দেবো সেটা না জানলে…।”
(বলতে বলতেই তিনি পা নামিয়ে দাঁড়িয়ে সুর পাল্টে বলেন ) …দামটা ব’লবো কি করে?”
আমার পিঠে কার যেন একটা স্পর্শ অনুভব করলাম। দেখলাম, ” আমার বন্ধু স্থানীয় শ্রীxyz, WBCS মহাশয় চুপটি করে এসে আমার পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে। মুখে মুচকি হাঁসি।


–” আমাকে না জানিয়ে, আমার বিভাগের দোকানে এসেছো? আমি এখানকার কর্মকর্তা। জানতে না ?…”
দেখি চারদিকের আরও অনেক আলো ফটাফ্ফট জ্বলে উঠলো। প্রতিটি স্ট্যাচুও জ্যান্ত হ’য়ে গেলো। সব্বার হাসি মুখ। ম্যাজিক ।
**** **** **** **** ****
একই দোকান, একই মানুষ, কিন্তু পরিবেশের এতো পরিবর্তন সামান্য একটু হাসিমুখে কথা বলা দিয়ে ঘটানো যেতে পারে। ফালতু স্বাভিমান, অহেতুক আত্মম্ভরিতা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, অসহযোগ করা, আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে। বাঙালি হাসতে ভুলে গেছে। কিন্তু এতে পয়সা লাগে না, বিদ্যে- ডিগ্রী, আসল বা নকল যাই হোক, কোনো টাই লাগেনা, আত্মসম্মানও কমে না, শুধু চাই দিল খুলে হাসতে। তাতেও কার্পণ্য ? তাতেও ফাঁকি !!
হাসা ব্যাপারটা খুব ছোঁয়াচে। আমি যখনই আমার ম্যাজিক শুরু করি, আমি পর্দার পেছনে, সামনের দর্শকদের দিকে মুখ ক’রে, প্রাণ খুলে, দাঁত বের করে হাসি। নকল হাসি নয়, অন্তর থেকে পবিত্র খুশি হওয়ার হাসি। তাঁর সঙ্গে বুকের ভেতরকার গরম, ভারী হাওয়াটা বের করে দিই। মনে মনে বলি, এই যে এত গুলো মানুষ এতো ঝক্কি ব’য়ে একটু আনন্দ পাবার আশায়, অগ্রিম টিকিট কেটে এসেছেন। আমাকে এই এতোটা বিশ্বাস, ভরসা ক’রে এসেছেন, আমি যেন তার যথাযোগ্য
সম্মান দিতে পারি। ওঁরাই তো আমার ঈশ্বর। ওরা আসেন ব’লেই আমি খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। ব’লেই স্টেজকে মন্দির হিসেবে প্রণাম করি। বাবা-মাকে মনে মনে প্রণাম ক’রে, আমার দিকে নজর রাখতে জেগে উঠতে বলি। দলের সবাই আমাকে কেন জানিনা প্রণাম করে। সব শেষে প্রণাম করে জয়শ্রী এবং মানেকা। মানেকা আমার অনুমতী নিয়ে বলে,”Start the show”. পর্দা উঠে যায়। স্টেজে একটা বিশাল বই রয়েছে। জাদুবিদ্যার ইতিহাস। ওর পাতা ওল্টাতেই আমি তার পৃষ্ঠা থেকে আবির্ভূত হই। হাসি মুখে।
ও-মা, আমি দেখি আমার সামনে আমার ঈশ্বরেরা ব’সে আছেন । আমায় দেখা মাত্রই, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা হাততালি দিয়ে উঠলেন । ওঁরাও দাঁত বের ক’রে খুশিতে, আনন্দে হাসছেন। সব হাসি মিলে মিশে একটা পবিত্র, স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আমি, দর্শক সবাই হাত ধরাধরি করে, কেমন যেন নিশ্চিন্তে হাওয়ায় ভেসে যাই। সেই আনন্দের জগতটাকে জিইয়ে রাখা, টিকিয়ে রাখা যেন আমাদের একটা দায়িত্বের মধ্যে এসে পড়ে। কেউ ছন্দপতন করলে বাকি দর্শকেরা তাকে ধমকে, শুধরে দেন। মনে হয়, ঈশ্, আমার এই প্রেক্ষাগৃহটা যদি বিশ্বজুড়ে হ’তো, তাহ’লে কি ভালোই না হ’তো ! পৃথিবীর সব কিছুই হ’তো দুর্দান্ত। সবাই আমরা হাসছি। কারুর কোনো দুঃখের কথা মনেও নেই। ভুলে গেছেন। কি সুন্দর, কি আনন্দের, কতো আবেগের আদর মাখা এই ‘ভুলে যাওয়া’টা। দুঃখটা ভুলে যেতে কপাল লাগে।
বাঙালির সব আছে। কিচ্ছু হারায় নি। মাঝে মাঝে একটু দুষ্টুমি করতে কিছু পাগলা-পাগলিরা গজিয়ে ওঠে। এক প্যাকেট তাসে দুটো জোকার আর একটা এলেবেলে তাস তো থাকবেই। সার্কাসে থাকে না ? ওরা এসে সব নিয়ম ভাঙ্গে। না ভাঙ্গলে
সার্কাসের কোনো মজা নেই ।
আমাকে প্রাণ খুলে হাসতে শিখিয়েছে, আমার কণ্যেরা ।

জয়শ্রীর কাছে যখন বকুনি খাই, তখন সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আমাকে হেসে ভুলিয়ে দিতে শিখিয়েছে ওরাই। ওরকম নিষ্পাপ হাসি মুখ দেখলে কি আর দুঃখ টুঃখ থাকে ? আসুন, দুঃখ ভুলে হাসতে শুরু করি। বাঙালির এখন হাসবার পালা শুরু করা যাক। “প্রতিদিন যদি কাঁদিবি তোরা, একদিন নয় হাসিবি আয়।….
ফুল সে হাসিতে ঝড়ে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়।…”
নিন, ছবিতে দেখুন, মানেকা আমায় হাসতে শেখাচ্ছে। আপনিও শিখে নিন।
তবে রাজমুকুট মাথায় দিলে সব হিসেব পাল্টে যায়। সেটাও দেখছি ওই ছোট্ট বয়সের মানেকার মধ্যেও ঘটে ছিলো।
সে গল্প পরে ব’লবো। আপাততঃ হাসুন।
জয় হিন্দ। আপনাদের প্রদীপ।

More from CultureMore posts in Culture »
More from EntertainmentMore posts in Entertainment »
More from GeneralMore posts in General »
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.