সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৬ মার্চ ২০২২। সদ্য সমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। বিরোধীদের ভোট ভাগাভাগি আর ধর্মীয় বিভাজনে বিজেপি ফায়দা তুলেছে। ইতিমধ্যে এ রাজ্যে কলকাতা পুরসভা ও রাজ্যের পৌরসভার নির্বাচনও হয়ে গেছে। জনমত রাজ্যের শাসক দলের প্রতি। এখন আবার উপ নির্বাচন। আসানসোল লোকসভা ও বালিগঞ্জ বিধানসভা। আসানসোলে শত্রুঘ্ন সিনহাকে প্রার্থী করে তৃণমূল জোর চমক দিয়েছে। বালিগঞ্জ বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী করেছে বিজেপি থেকে চলে আসা বাবুল সুপ্রিয়কে। বাবুল কিন্তু আসানসোল কেন্দ্র থেকে আগের বার জিতেছিলেন। তৃণমূল এবার বাবুলকে আসানসোলে প্রার্থী করতে ভরসা পায়নি। কেননা ২০১৮সালে রাম নবমীর রাত্রে আসানসোল পৌরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা চেতলাডাঙ্গা নদীপারের নূরানি মসজিদের ইমাম মাওলানা ইমদাদুল রশিদের ১৭বছর বয়সী ছেলে সিবতুল্লা রশিদ নিখোঁজ হয়ে যায়। ২০১৯ এর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সিবতুল্লার ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ মেলে পরদিন। অভিযোগ চরম হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হয় সে। তখন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ ছিলেন বাবুল সুপ্রিয়। তারপর বহুদিন কেটে গেছে অথচ সে খুনের কোনও সুরাহা হয়নি। ফলে আসানসোল বাবুলের জন্য নিরাপদ আসন নয়। তাই সেখানে শত্রুঘ্ন সিনহাকে বিহার থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। বাবুলকে নিরাপদ আসন বালিগঞ্জ বিধানসভা দেওয়া হয়েছে। আসনটি বরাবরের তৃনমূল বিধায়ক ও জনপ্রিয় মন্ত্রী প্রয়াত সুব্রত মুখার্জির ছিল। এমনটাই মনে করেন বিরোধী দলের নেতারা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাবুল দলের সবুজ সংকেত পেয়ে বালিগঞ্জ কেন্দ্রে তুলি হাতে দেয়াল লিখনেও নেমে পড়েছেন। এরই মধ্যে বাবুলের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে ইমাম অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান মহঃ ইয়াহিয়া সংবাদমাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তৃনমূল দলটিকে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ বলে জানি। কিন্তু এই উপ নির্বাচনে সেখানে সদ্য বিজেপি থেকে আসা এমন একজনকে প্রার্থী করেছে যে আসানসোলে ২০১৮তে চরম হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিহত একটি ১৭বছরের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলের ঘটনায় হাত রঞ্জিত করেছে। এখনও সে পরিবার আইনের বিচার পায়নি। ফলে তৃণমূল যদি বালিগঞ্জ বিধানসভার প্রার্থী বদল না করে তবে ইমাম অ্যাসোসিয়েশন সেখানে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করাবে।
ইমাম সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, দলের প্রার্থী নির্বাচনে ধর্মীয় সংগঠনের এমন বক্তব্য সমীচীন নয়। স্বয়ং প্রার্থী বাবুল বলেছেন,আসানসোলের ঘটনায় মানুষের ক্ষোভ থাকতেই পারে। ইমামদেরও ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু দল বদল করেছি, অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে। আমি সরাসরি যোগাযোগ রেখে সেই ক্ষোভ মেটাতে সচেষ্ট থাকব।
প্রশ্ন,স্বয়ং সন্তানহারা পিতা ইমাম রশিদ নিজে বলেছেন,আমি বিচারের প্রত্যাশা করি না। খুনিকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। সেই সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষোভকে বিচক্ষণতার সঙ্গে সংযত করেছিলেন সন্তানহারা পিতা ইমাম রশিদ। প্রতিবেদকের সঙ্গে সরাসরি ফোনে ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোঃ ইয়াহিয়া জানালেন, আসানসোলের ইমাম পুত্রকে হত্যায় ইন্ধন দিয়ে বিজেপির গুড বুকে গিয়েছিলেন বাবুল। সেই বাবুলকে দলে নিয়ে এমনকি ভোটের টিকিট দিয়ে এক অন্যায় করলো ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা দল তৃণমুল। বুধবার সন্ধ্যায় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের অনুরোধে নবান্নে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেন ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহঃ ইয়াহিয়া। কিন্তু সেই আলোচনা শুরুতেই ভেস্তে যায়। আলোচনার টেবিলে ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে মহঃ ইয়াহিয়া বাবুলের মনোনয়নের বাতিলের দাবি জানালে ফিরহাদ জানান, বাবুলের মনোনয়নের সিদ্বান্ত স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর।
সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। আপনারা বিরোধিতা করলেও বাবুল বহু ভোট জিতবেন। কেননা বাবুল উপলক্ষ্য মাত্র। আসল প্রার্থী তো মুখ্যমন্ত্রী। জবাবে মহ: ইয়াহিয়া জানান, বাবুল জিততেই পারেন। কিন্তু বিনা প্রতিবাদে তাঁর জয় মেনে নেওয়া কোনও গনতন্ত্রপ্রেমী মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে যদি উনি কম ভোট পান সেখানেই হবে আমাদের নৈতিক জয়। মহ : ইয়াহিয়া ফিরহাদ হাকিমের কাছে তিনটি প্রশ্ন রাখেন। এক) তৃনমূল কংগ্রেসের একজন প্রার্থী হিসেবে কি অবদান আছে ওঁর? বরং বিজেপিতে থাকাকালীন মুখ্যমন্ত্রী, আপনার ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায় সম্বন্ধে বহু কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন। সেটাই কি তাঁর যোগ্যতা? দুই)বালিগঞ্জ কেন্দ্রে কি সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পরিপূরক কোনও স্থানীয় নেতা নেই যাকে প্রার্থী করা যেত? তিন) মুখ্যমন্ত্রী কি এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চান, যে যাঁরা মায়ের সন্তানকে হত্যা করে হাতে রক্ত মাখবে দল সেই যোগ্যতায় তাকে নির্বাচনের টিকিট দেবে? বালিগঞ্জ কেন্দ্রে বাবুলের প্রার্থীপদ যদি মুখ্যমন্ত্রী বাতিল না করেন, আমরা বৃহস্পতিবার থেকে পথে নামব। বালিগঞ্জ কেন্দ্রে পথসভা করে ভোটারদের অনুরোধ করব সন্তানহারা মায়ের মুখ চেয়ে বাবুলকে বয়কট করুন। আমরা বাবুলের মনোনয়ন মেনে নেব না। গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেকের অধিকার আছে কোনও অভিযুক্ত প্রার্থীকে বয়কট করা বা তার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া। মহঃ ইয়াহিয়া এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই তৃণমূল দলের বালিগঞ্জ কেন্দ্রের বহু কর্মী গোপনে জানিয়েছেন, বাবুলের মনোনয়নে তাঁরা খুশি নন। কিন্তু দলের ওপরতলার সিদ্ধান্তে তাঁদের কিছু করার নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাও জানিয়েছেন, ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের এই ন্যায্য দাবির প্রতি তাঁদের নৈতিক সমর্থন আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ঝালমুড়ির স্বাদ বাবুল ভুলতে পারেননি। তাই গেরুয়া পাঞ্জাবি ছেড়ে গড়িয়াহাটের এক দোকান থেকে এক ডজন সাদা পাঞ্জাবি কিনে নিলেন বাবুল। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হলো। বাড়তি মিডিয়ার প্রচার পেলেন এবং তাঁর প্রার্থী পদ পাওয়া নিয়ে যাঁরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তাঁদের খোঁচাও দিলেন। মহ: ইয়াহিয়া জানিয়েছেন,২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন ও ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করে বাবুল বিরোধী প্রচারের রূপরেখা তাঁরা তৈরি করবেন।
Be First to Comment