Press "Enter" to skip to content

আমি কি প্রেমের সময় জিজ্ঞেস করেছি, নাকি জানতাম, তুমি ঘোষ না বোস? শুভ দৃষ্টির সময় থেকেই চোখ কটমাটানি………. !

Spread the love

///////[প্রদীপের সঙ্গে আলাপ=প্রলাপ]\\\\\
===≠=======(পর্ব-০৩৭)===============
পুচি-মীটার****
জাদুশিল্পী প্রদীপ চন্দ্র সরকার
(Dr. P.C.Sorcar Junior, M.Sc., Ph.D) কলকাতা, ১১, ফেব্রুয়ারি, ২০২১। শীতটা কেমন দুম্ করে ঘাড়ে এসে পড়লো! সব্বাই আমরা যখন সবে গরম ফিরে আসার চুককি খেয়ে বলতে শুরু করেছি "...এবার শীতও কেমন দায় সারা ভাবে, শর্ট-কাটে কেটে পড়লো" ... তক্ষুনি ঘটলো তার ঝটপট্ দ্বিরাগমনের শখ!! কোন মতলবে কে জানে ? "যেতে যেতে দূয়ার হতে, কি ভেবে ফিরালে মুখ খানি?"

শীত একটু আগে এলেও দোষ, আবার পরে এলেও দোষ!! দেরী করলেও বকুনি, আগে এলেও বকুনি। পুরো ফোকাসটা আমার দিকে। গিন্নী আমাকে কি জানি কোন দরকারে, এ বাড়ির ‘নন্দ ঘোষ’ বানিয়েই ছাড়বেন। আরে বাবা, আমি ‘সরকার’, ওই ফোশ্ ফোশ্ করা ঘোষ – টোষ নি। সেটা তো ছিলে তুমি ! বিয়ের আগে। কার্ডে বড় বড় করে ছাপা সোণালী অক্ষরে লেখা “পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত ঘোষ পরিবারের শ্রী অরুণ কুমার ঘোষের প্রথমা কণ্যা শ্রীমতী জয়শ্রী ঘোষের সহিত…।”

কি দরকার ছিলো এই সরকার বাড়ির নিরীহ ছেলেটার সাথে হাতে হাত ধরিয়ে, ঘটের ওপর হ্যাণ্ডশেক করাবার? আমি কি প্রেমের সময় জিজ্ঞেস করেছি, নাকি জানতাম , তুমি ঘোষ না বোস ? শুভ দৃষ্টির সময় থেকেই চোখ কটমাটানি ! ছাদনাতলায় আমি ভ্যাঁ করে কাঁদিনি বলে ভেবেছো আমি যেন বাড়ির বাসন-মেজে দেওয়ার জন্য রাখা, ঠিকে কাজের মাসী ? আগে বাসন মাজতে এলে বলবে, “শান্তিতে খেতে দেবে না”; আর দেরী করলে বলবে, ” এ চায়না যে আমরা সময় মতো শান্তিতে খাই।” কাজের মাসী নন, শীতের হয়ে আমি ওকালতি করি। জিজ্ঞেস করি বৌকে, আর তারপর নিজেকে, " কোনটা চাই তোমার ? শীত আগে না পরে ?"

বৌ বলে, “তোমার কি দরকার, অ্যাঁ ? এই হতচ্ছাড়া কোভিডের জন্য এই মরদটা স্টেজ ছেড়ে বাড়িতে থেকে, ঘাড়ের ওপর সারাক্ষণ বসে, বেকার মানুষের মতো, ঘরের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন। জীবনে একটু প্রাইভেসিও রইলো না। যাও , নির্বাসনে, গৃহকোণে মুখ গুঁজে বসে বসে, ফেস বুকে ফাঁশো।”

তবে তাই হোক। শীতের কতটা প্রকোপ চলছে, তা মাপার কোনো যন্ত্র আমার নেই। আমি শীতেও কাঁপি, বৌ-এর ভয়েও কাঁপি । কোনটা কেন, তা বুঝি না। বলে দিতে হয়।কাছে বলে দেবার কেউ না থাকলে, এদিক-ওদিক লক্ষণ দেখে বুঝে নিতে হয়। যেমন, যদি ভূমিকম্প হয়, তাহলে বুঝি ওনার আলমারির চাবিটা খুঁজে পাচ্ছেন না। ন্যাচারালি, দোষটা আমার। “সংসারের দিকে নজর নেই। একটু খুঁজেও দিচ্ছে না।” ফেস বুক ছেড়ে খুঁজতে উঠি।
হঠাৎ করে যদি সেই ভূমিকম্প বন্ধ হয়, তো আফটার শকের জন্য ওয়েট করি। বুঝি, পেয়েছেন, কিন্তু নিজের ব্যাগে। যদি সেটা চটপট আসে, তো বুঝতে হবে পাওয়া গেছে আমার টেবিলের ওপর।যদি নরম কণ্ঠে বলেন, “কফি খাবে?” তার মানে উনি একটু মার্কেটিং-যাচ্ছেন।আর যদি রুক্ষ কণ্ঠে বলেন, বুঝি আমার শালা বাবু আসছেন। ওরা দলে ভারী।
আর যদি টোস্টেড স্যণ্ডুইচে মিক্সড্ ফ্রুটের জ্যাম, মাখন আর তার ওপর স্লাইজ্ড্ চিজ থাকে, তো বুঝে নিতে হবে, উনি ব্ল্যাঙ্ক চেকে সই করিয়ে নিয়ে পি সি চন্দ্রর দোকানে যেতে চাইছেন।
তখনো কাঁপি। দেউলিয়া হবার ভয়ে। উনি বলেন, “জ্বর জ্বর লাগছে? তুমি বাড়িতে শুয়ে থাকো। আমি চট্ করে একটু ঘুরে আসছি।” আমি লক্ষ্মী সোণার মতো ঘাড় নেড়ে শুয়ে থাকি। শুয়ে ভাবি, “…মানুষ যাবার সময় কিচ্ছু নিয়ে যায় না…সব রেখে দিয়ে যায়…বৌ-বাচ্চার জন্য…দু-দিন আগেই না হয় নিয়ে নিলো!”



আমার ছোট মেয়ে মুমতাজ একদিন শুটিং সেড়ে বাড়ি ফেরার সময় দেখে রাস্তায় একটা দিশী কুকুরের বাচ্চাকে আঘাত দিয়ে একজন গাড়ি নিয়ে পোঁ-পা করে পালিয়ে গেল। লোকটাকে তাড়া করবে, নাকি কুকুর টাকে সেবা করবে, এই দোনোমোনোয়, কুকুরের বাচ্চাটার কাছে এসে হাসপাতালে নিয়ে যায়।…সুস্থ হয়…তারপর ?
সেই থেকেই ও আমাদের বাড়িতেই রয়ে গেছে। প্রচণ্ড সুন্দরী। বয়স বাড়ছে, রূপও বাড়ছে।এখন বয়স হবে আন্দাজে..যদিও মেয়েদের বয়স জানতে নেই, রহস্যময়ী…তা, তের বছর+ তো হবেই। ১৩ বছর ও আমাদের কাছেই আছে। মানুষ এবং কুকুরের বয়সের অনুপাত বা রেশিও হচ্ছে, সাত'। মানে মানুষের হিসেবে ওর বয়স এখন ১৩×৭=৯১. মানে উনি একানব্বুই বছরের এক বৃদ্ধা।আমার থেকে বয়সে অনেক বড়ো! অনেক শ্রদ্ধার চিরকুমারী । অপ্সরাদের মতোই চির-যৌবনা, অজ্ঞাত-কূলশীলা।

কর্পোরেশনের পেট-ডগ লাইসেন্স করাবার সময় রেজিস্টারে নাম, জাত, বয়স দিতে হয়। নাম বলা হয়েছিলো ‘পুচি’; ‘পুচি কুমারী। এটা ওর ডাকনাম। পোষাকী, ভালো নাম হলো ‘প্রিন্সেস’; এবং পদবী হলো ‘সবাসা’। মানে সরকার বাড়ির সারমেয়…সংক্ষেপে ‘ স.বা.সা’।”

—” জাতে কি লিখবো ? হেঃ হেঃ, বুঝেছি রাস্তার লেড়ি কুত্তা বলতে আপত্তি করবেন। তার এখানে কী লিখবো?’লেড়ি-টেরিয়ার’, নাকি, ‘রোডেশিয়ান’ ??”
—” লিখুন মঙগ্রিয়াল… প্রজাতি অফ্ বেঙ্গল।
__”কাইণ্ডলি বানানটা বলুন।”
বললাম।
—-“He ? নাকি She ?
—-“কুমারী কখনো He হয়?”
ভদ্রলোক জিভ কাটলেন।

পুচি কুমারীর বয়স হয়েছে। বারান্দায় বসে জয়শ্রীর বারান্দা-বাগান সামলায় এবং লোক দেখিয়ে, মানে পাশের বাড়ির কুকুরগুলোকে ফিগার দেখিয়ে ‘সান-বাথ’ করে। ওর সঙ্গে আমার খুব রুটীন বাঁধা হৃদ্যতা। ও সময়মতো লোক বিশেষের সঙ্গে কাজ করে। আমার সকালের চা-বিস্কুটের মধ্যে, চা নয়, বিস্কুটে ওর ১০% শেয়ার বরাদ্দ। ওর জন্য আলাদা খাবার দেওয়া হয়, কিন্তু আমার ওই শেয়ারটুকু না পেলে কুই কুই করে কেঁদে সবাইকে জানান দেয়। এটা ওর ইজ্জত কি সাওয়াল। বাড়িতে দুটো বিরাট সাইজের ইংলিশ ম্যাস্টিফ কুকুর আছে। পুচি ওদের পরোয়া করেনা। হেঃ, সেদিনকার শিশু। এবং ওর ইজ্জত দেখাবার জন্য ও সকালের ওই ১০% বিস্কুটের অধিকারটা নিয়ে খুব গর্বিত। যেন পূজোর প্রসাদে যবনদের স্পর্শ নিষেধ।


আজ সকালে উঠে কম্বল সড়িয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ঘন কুয়াশা। সকালটা কেমন ঠাণ্ডা তা জানতে জয়শ্রীকে প্রশ্ন করি, ” কম্বলচাপা বাইরের পৃথিবীতে শীত কতোটা?”
জয়শ্রী বলে,”পুচি-মীটার দ্যাখো।”
পুচি মীটার আমাদের সব সময় ঠিক খবর দেয়।রোদ ঝলমলে হলে ও বিছানার বাইরে বসে থাকে। শীতের আমেজ থাকলে ও কম্বলের বাইরে অর্ধেক শরীর রাখে। বেশ ঠাণ্ডা হলে শুধু মাথাটা বাইরে রেখে, গা থাকে চাপা। কিন্তু আজ….আরে !!?? এ কি ?? পুচি কোই? ভ্যানিশ! শুধু কম্বলটা গুটিয়ে রয়েছে। পুচি নেই!! বুকটা ধক্ করে উঠলো।
ওর বয়স ৯১ !! সিনিয়ার-তম বাসিন্দা।
ধরমর করে উঠে কাছে গিয়েও ওকে দেখতে পেলাম না।
ডাকি, “পুচি !! বাবা,…তুই কোই?”
জয়শ্রীও এগিয়ে আসে। ও-ই আবিষ্কার করে, পুচি যতোটা পারে গুটিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে চেপে কম্বলের তলাতেই শুয়ে আছে। একটা কান শুধু রেখেছে বাইরে । বাঃ, ১০% পাওনার জন্য ডাক যদি ও শুনতে না পায়, তাহলে চলবে কি করে?
আমার চোখে পড়েনি।
আজ পুচি -মীটার একটু আয়েশ করছে।
বাইরে জানালা দিয়ে দেখেছি , কুয়াশায় সব সাদা হয়ে আছে। সূর্যিমামাও ঘাবড়ে পুচিকে না দেখে, হয়তো, টাইম না বুঝে, বিছানার সাদা চাদরটা জড়িয়ে ,উঠবার জন্য পূব দিকটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

আমরাই শুধু বোকার মতো ঘড়ি ধরে উঠেছি।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.