ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী, ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ২৫, নভেম্বর, ২০২০। আমার ছোটবেলায় বাড়িতে ম্যাজিকের রামধনু উঠতো, প্রতি মাসের শেষ শনিবার, সন্ধেবেলায়।বাবার সভাপতিত্বে, অল ইন্ডিয়া ম্যাজিসিয়ান্স ক্লাবের মাসিক অধিবেশন বসতো সেই সময়ে। মিটিং শুরু হওয়ার আগে, তার চেয়ার, টেবিল, ফুলদানি, শতরঞ্চি, ব্ল্যাকবোর্ড, চক ইত্যাদি সব ঠিকঠাক আছে কিনা, তার তদারকি করবার দায়িত্ব ছিল এক সহকারীর ওপর। ভদ্রলোকের দৌলতে আমি অধিবেশন শুরু হওয়ার অনেক আগের থেকেই ওই সভায় উপস্থিত এবং মাতব্বরি করার সুযোগ পেতাম। বাপের জমিদারি হলেও বাবার রক্তচক্ষু এড়ানো যাবে না। হুঙ্কার শুনবো, “এখানে কেন? পড়তে যাও”। সেজন্য আমি, ‘শরণাগত দীনার্ত’ সেজে মায়ের করুণাপ্রার্থী হয়ে, বাবার কৃপা লাভ করে মিটিং-এর এক কোণে বসে থাকার অনুমতি পেয়েছিলাম। অতিরিক্ত অধিকার টুকু আমরা তিন ভাই-ই গতরে খেটে আদায় করে নিয়েছিলাম। মিটিং-এ চা পরিবেশনের জন্য বিশাল এক কেটলি ছিল। তাতে গোটা চল্লিশ-কাপ চা আটতো। আমরা ঐ ডাইনোসর আকৃতির গরম কেটলিটা খুব কায়দা করে কাত করতাম। ট্রে-তে কাপে চা ঢেলে পরিবেশনও করতাম। এবং প্রসাদ হিসেবে প্রতিটি পরিক্রমায় এক কাপ করে চা নিজে খেয়ে নিতাম। এ-ভাবে চার-পাচ কাপ চা খেয়ে একমাসের কোটা পূরণ করতাম। কেন না, বাড়িতে তখন চা হলেও আমাদের বরাতে কোনোদিনই তা জুটতো না। ছোটবেলার যে কী জ্বালা, তার একমাত্র ‘জুনিয়র’ না হলে কেউ বুঝবে না।
সুতরাং, মিটিং-এর আগে কাপ একত্র করা ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হোত। এভাবে একদিন কাপ একত্র করতে
একটু দেরী হয়ে যায়। আমার কপাল খারাপ। ততক্ষণে একটা বি-রা-ট জিনিষ ঘটে যায় আমার অলক্ষ্যে। না, কোনো বড় ম্যাজিক নয়। তবে তার চেয়ে কম কিছুও নয়। ক্লাবের একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন শ্রী রমাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। উনি নাকি গোবরডাঙ্গার জমিদারবাড়ির একজন। উনি সেদিন কী যেন কী এক ঘটনার জন্য উৎসব পালন করতে এক কৌটো ভর্তি চকোলেট লজেন্স নিয়ে এসেছিলেন। আমি আসবার আগেই সেগুলো বিতরন হয়ে যায়। এবং শেষও। আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই সলজ্জভাবে জিভ কেটে, ইশ্, ইশ্
করে ওঠেন। আমি প্রথমে ব্যাপারটা একদম বুঝিনি। কিন্তু সুরুচি বান রমাপ্রসন্নবাবু আর কথা না বাড়িয়ে আমায় ডেকে বলেন, “তোমার অজান্তে আমরা একটা ভুল করে বসেছি। চকলেট গুলো সবাই খেয়ে ফেলেছি…খালি কৌটোটা আছে…এটা কি তুমি নেবে?”
আমি মন্ত্রমুগ্ধ ! চকোলেটের চেয়ে অনেক ভালো, বড় উপহার মনে হল ওই চকচকে মেরুন রঙের গোল পালিশ করা কৌটোটাকে। ওপরে সোনালি কাগজে লেখা ‘ফিরপোস’, দি কনফেকশনার্স অফ ক্যালকাটা’। ‘ফিরপো’ নামেই তখন ম্যাজিক। কৌটোটা খুললাম। ভেতরে সাদা কাগজের মাদুর। চকোলেট একটাও নেই। কিন্তু গন্ধ আছে। আমি একগাল হেসে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ছুট লাগাই মা-কে দেখাবো বলে। রান্নাঘরের পাশে দেখি ঠাকুমা। বললেন,-“এত জোর দৌড়াচ্ছ কেন, দাদু?” ফলে, ঠাকুমা কেই প্রথম ওই দুর্মূল্য উপহারটা দেখাই।
-“দেখি, দেখি । বাঃ চমৎকার । খুব সুন্দর তো কৌটোটা! এটা নিয়ে তুমি কী করবে, দাদু?”
চোখে মুখে ঠাকুমার একদম আমার সমবয়সী ছেলেমানুষী!! কৌটোটা উল্টেপাল্টে যেভাবে দেখছেন, খু–ব যে পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারি। খুব জোরে, কষ্ট করে ঢোক গিলে বলি,..”আ-মা-র কোনো কাজে লা-গ- বে না। কী করবো এই কৌটো নিয়ে…তুমি নেবে ??!!?”

ঠাকুমা, কুসুম কামিনী দেবী যতোই ময়মনসিংহের প্রগতিশীলতা মহিলা, বা জাদুসম্রাট পি সি সরকারের রত্নগর্ভা জননী, বা ভগবান চন্দ্র সরকার নামক সর্বত্যাগী সমাজসেবী, গোপন বিপ্লবীর সহধর্মিণী স্ত্রী হোন না কেন, ফ্রয়েডের হিসেবে তিনিও ছোট্ট একটা মেয়ে। তার গায়ে পরিবেশ, স্বপ্ন, রূপকথা, দীনতা, সমাজ…সব কিছু মিলিয়ে একটা খোলস চাপা দিয়ে রেখেছে। কৌটোটা দেখে ভেতরের সেই ছেলে-মানুষী চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। আমার বয়স তখন যতো কাঁচাই হোক না কেন, সমবয়সী এক বান্ধবীকে তাঁর মধ্যে দেখে আমি ঠিক চিনতে পারি। বলি,” তুমি নেবে? এটা আমার লাগবে না।”
ঠাকুমা লজ্জা পেয়ে যান। “না, না, আমি ঠাট্টা
করছিলাম।”
কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। দেবই। এবং জিতবোই। ঠাকুমা নিলেন। কৌটোটা হাতে নিয়ে খুলে, দেখে, শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখ মুছে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কতো আদর, কতো আশীর্বাদ করলেন। আমার বুক ভরে গেলো।
পরবর্তীকালে ঠাকুমা কতো জনকে যে এই গল্প করেছেন এবং আমায় লজ্জা দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
একদিন ঠাকুমা মারা গেলেন। তদ্দিনে ইতিহাস কতো পাল্টে গেছে। জামির লেনের বাড়ি ছেড়ে বাবা বড় রাস্তার ওপর বিরাট বাড়ি করেছেন। কাকা বাড়ি বানিয়েছেন সেলিমপুর রোডে। ঠাকুমার শেষকৃত্য করা হয়ে গেছে। ঘরদোর থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র বের করে দেওয়া হচ্ছে, যা আর কোনো কাজেই লাগবে না। হঠাৎ দেখি , আর কেউ না চিনলেও, আমি পরিষ্কার চিনেছি, সেই রমাপ্রসন্নবাবুর দেওয়া ফিরপোর চকোলেটের কৌটোটা। একটু তুবড়ে গেছে। চাকচিক্য বেশ মলিন। হতশ্রী!! ভেতরে মরচে ধরা কয়েকটা সূচ, রঙ-বেরঙের কিছু সুতো আর বোতাম । কারো কাজে লাগবে না। কৌটোটার প্রতি কারো কোনো দায়দায়িত্ব নেই। জনে জনে উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি, কৌটোটা আমি নিতে পারি?
কেউ আপত্তি করে নি।
আমি আমার ঘরে এসে কৌটোটায় ভালো করে হাত বুলাই। কী আশ্চর্য, আমি ঠাকুমার স্পর্শ পেলাম। গন্ধ শুকি। চকোলেটের গন্ধ নেই, কেমন ঠাকুমা-ঠাকুমা গন্ধ।
কৌটোটা এখন আমার কাছেই আছে।

Be First to Comment