গৌড়দার গপ্পো (১) জাদুশিল্পী পি সি সরকার জুনিয়র।
ডঃ প্রদীপ চন্দ্র সরকার এম এস সি, পি এইচ ডি।
আমাদের বালিগঞ্জের ‘পূর্ব পল্লী’ পাড়ায়, ‘গৌড়দা’কে চেনেন না অ্যামোন মানুষ অ্যাকজনকেও পাবেন না। অ্যাত্তো পরোপকারী মানুষ, আমি হলফ ক’রে ব’লতে পারি, ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয় অ্যাকজনকেও ঈশ্বর বানান নি। উনি অতুলনীয়। সব সময়েই হাসি খুশী আর তরতাজা।আর শুধু তা নয়, নোতুন নোতুন কাণ্ডকারখানা ওনাকে কেন্দ্র ক’রে ঘটতে থাকে। সে-সব ঘটনা আমি আপনাদের জানাতে থাকবো। আপনারা, জানি, খুশি হবেন।
ওনার জগতে য্যানো দুঃখ, কষ্ট, ঝগড়া, মন-খারাপের প্রবেশ অ্যাক্কেবারে নিষেধ। কারুর মন খারাপ দেখলে বা শুনলে, ব্যাস্, তার বাড়িতে তিনি গিয়ে হাজির হন। আগ বাড়িয়ে, সমাধান ক’রবার চেষ্টা করেন। কি য্যানো কি কারণে একটু সময় লাগলেও সমাধানটা উনি ক’রেই ছাড়েন।
চলার পথে ওনার দোকানের সামনে দিয়ে গেলে, যদি দ্যাখা না করি, তো উনি দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে, পথ আটকে বলেন, “কী হ’য়েছে, তোমার? হন্ হন্ ক’রে চ’ললে কোথায় ? তোমার. ..শরীর টরীর ঠিক আছে তো ?”
এ অ্যাক বাঁধাধরা ব্যাপার। সুতরাং ওনার দোকানের সামনে দিয়ে গেলে, একটু থেমে, দু-চার কথা না ব’ললেই নয়। নিদেন পক্ষে হাত নেড়ে বন্ধুত্ব বিনিময় ক’রতে হয়। তবে হ্যাঁ। ব্যাপারটা মনে হয়, সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। বিশেষ বিশেষ কয়েকজনের ক্ষেত্রে কঠোর ভাবে প্রযোজ্য। আমি তার মধ্যে অ্যাকজন। ভদ্রলোক আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমিও ওনাকে খুব ভালোবাসি, কারণ, ওনার চরিত্রটাই অ্যামোন যে ভালো না বেসে কেউ পার পাবেন না। ওনার নামে কাউকে কখনও বাজে কথা ব’লতে শুনিনি। বরঞ্চ, সবাই ওনার সম্পর্কে ভালো কথাই বলেন।
ওনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে, ওনার কতটুকুই বা জানি? উনি আমার কাছে, ঠিক য্যানো আ্যকটা ‘মোজাইক’-এর রঙচঙে টুকরো। নিরেট অ্যাক খণ্ড অ্যাক রঙা পাথরের চাঁই নন। একটু তোৎলা, কিন্তু সত্যি কথাই নাকি বলেন।
সব কিছুরই অ্যাকটা শুরু আছে। কিন্তু গৌড়দার সঙ্গে যে আমার প্রথম আলাপটা কখন এবং কোথায় হ’য়ে ছিলো, তা আমার মনে নেই। কিছু কিছু জিনিস আছে, যা অ্যাকটা ঘটনা বা ব্যাপারের সঙ্গে, ফাউ হিসেবে,প্রথম থেকেই ঘটে। বালিগঞ্জ পূর্ব পল্লীতে পুজো বা যাত্রার আসরে পাবলিককে জল খাওয়ানো, বা ট্রামের তার ছিড়েছে সেজন্য পুলিশ না আসা পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকায় ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করাটা, বা দোলের দিনে আবীরের স্টক ফুরিয়ে গেলে হঠাৎ ক’রে কোত্থেকে য্যানো এনে দ্যাওয়াটার মতো কাজ করাটাই ওনার বিশেষত্ব। সর্ব ঘটে তাঁর উপস্থিতিটা, ঠিক য্যানো ঢাকের সঙ্গে ধুনুচীর মতো থাকবেই থাকবে। সেজন্য, ওই ‘ফাউ জিনিস’ নিয়ে কেউই আর তার সম্পর্কে আলাদা চর্চা ক’রতেন না। আমিও গৌড়দার সঙ্গে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কখনোই করিনি।
এ হ্যানো গৌড়দাকে আমি আজ সকালে দোকানের ভেতর, টেবিলে মাথা রেখে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে ব্যাজার মুখে ব’সে থাকতে দেখি। এরকম দৃশ্য এর আগে কখনো দেখিনি। বুঝলাম, ব্যাপারটা শুধু সিরিয়াস নয়, খুবই সিরিয়াস।
কাছে গেলাম। সেই চনমনে, দৌড়ে আসা গৌড়দা, ক্যামোন য্যানো অ্যাক্ ঝটকায় পুরো পাল্টে গ্যাছেন। আমাকে দেখে সোজা হ’য়ে ব’সলেন। হাসবার চেষ্টা ক’রলেন। কিন্তু ক্যামোন অ্যাকটা দুঃখ- অশান্তি মাখা দৃষ্টি দিয়েই, মুখ নীচু ক’রে ফুঁপিয়ে উঠলেন। য্যানো, দুঃখের অ্যকটা ড্যালা পেট থেকে ঠেলে বুক পেড়িয়ে গলায় আটকে গ্যাছে। দুহাতে মুখ ঢেকে উনি টাল খেয়ে গেলেন।
আমি চট্ ক’রে ওনাকে ধ’রে নিই। সামাল দিই। বলি, ” কি হ’য়েছে গৌড়দা? আমাকে খুলে বলুন! ”
জবাবে গৌড়দা অ্যামোন অ্যাকটা কথা ব’ললেন, সেটা যে শুধু ওনার নয়, আমার জীবনের পক্ষে অ্যাতোটা গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা আমি ভাবতেও পারিনি । ভীষন চমকে যাই। অ্যামোন কথা কেউই আমাকে, অ্যাতো খোলাখুলি ভাবে বলেন নি। মনে হ’লো, সবাই য্যানো চক্রান্ত ক’রে চেপে গ্যাছে এবং অ্যাখনো চেপে আছে। পৃথিবীতে কাউকে আর বিশ্বাস করা যায় না। প্রেম, ভালোবাসা আর কাউকে করা যায় না। ক’রবো না।
গৌড়দা খোলা মনে আমাকে সোজা ব’ললেন:
—” তোমার দিকে তাকাতে পারছি না। কষ্টো পাচ্ছি!…তোমার শরীরটা যে অ্যাত্তো খারাপ, নোংরা আর দুর্বল….মনে হ’চ্ছে, এক্ষুনি , তোমার ম’রে যাওয়া ভালো।”
আমি চমকে উঠি! কী অ্যামোন খারাপ হ’য়েছে আমার, আর কী নোংরামি আমি ক’রেছি, যে এর থেকে ম’রে যাওয়াটাই ভালো ব’লছেন? আমার চেহারাটা অ্যাতোটা খারাপ হ’য়ে গ্যাছে? কেউই তো আমায় সেকথাটা বলেন নি।
হ্যাঁ, জানি, কোভিডের সময়ের পর থেকে, শো বন্ধ করার দরুন আমি দৌড়ঝাপ, হাটাচলাটা একটু কম ক’রছি । লেখালিখি নিয়ে বসতে বাধ্য হ’য়েছি। মানে, মাথার কাজটা বেশি, আর শারীরিক পরিশ্রমটা কম হ’চ্ছে। গৃহবন্দী হ’য়ে আছি। তাতে চেহারায় অ্যাকটা পরিবর্তন তো আসবেই। বুঝি । কিন্তু,অ্যাতোটাই যে খারাপ হ’য়ে গ্যাছে ….যে ,আমার অ্যাখোন ম’রে যাওয়াটাই ভালো,…তা তো কেউ বলেন নি।
আমার বৌ-ও না।
নেহাৎ গৌড়দা সরল মনে , মুখ ফস্কে কথাটা ব’ললেন ব’লে জানলাম!
মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা ক’রলাম। মনটাকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে,নিজের মুখে, গালে, বুকে হাত বুলিয়ে তারপর দুহাতের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখে বলি:-“অ্যামোনটা তো সবারই হয়। সময় বদলাচ্ছে। বয়সও তো হোচ্ছে। পেট ভ’রে ঠেসে খেয়ে, মুখ বুজে থেকে সহ্য ক’রে থাকলেই সব ঠিক হ’য়ে যাবে। ম্যাজিক!
গৌড়দা প্রায় চিৎকার ক’রে ওঠেন। বলেন ” পেট ভ’রে খাওয়া…ঠেসে..!? মাথা খারাপ? তার চেয়ে এক্ষুনি তোমার ম’রে যাওয়া ভালো। ওঃ ভগবান! তুমি অ্যাতো নির্দয়?
সুইসাইড, তোমার সুইসাইড করা ভালো।
এভাবে বাঁচাটা, তোমার ঠিক নয়। অসহ্য!”
শুনে আমি ভিরমি খাই। কেউ আমাকে এই ভয়ঙ্কর সত্যি কথাটা বলে নি। কেউই না। ঢোক গিলে, বিস্তারিত ভাবে শুনতে আরও ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলি:-
গৌড়দা, আমাকে মন খুলে বলুন তো, কি খারাপ, ,কতোটা খারাপ? ক্যানো খারাপ? সব খুঁটিয়ে বলুন।
গৌড়দা আমার দিকে তাকিয়ে,চোখ নামিয়ে ন্যান। বলেন: “বোলছি, সব বোলছি, আর চেপে রেখে কী হবে? তবে প্রদীপ, শুনে, তোমার মন খারাপ হ’য়ে যাবে। আর কোনও দিনও তোমার…”
— না না, আমি মন শক্ত ক’রতে জানি। বাস্তবকে আমি মানতে জানি। মেনে নিতে হয়। অ্যাতোদিন পারলাম, আর এটুকু পারবো না? সব পরীক্ষা। আপনি বলুন। সব খুলে বোলুন। নিশ্চিন্তে বোলুন।
গৌড়দা একটু দম নিলেন।
তারপর ব’ললেন:
—অনেকদিন পর, তোমার বৌকে নিয়ে একটু বাইরে ব্যাড়াতে গেছিলাম।
শুনেই আমি চমকে উঠি। গৌড়দা !, আমার বৌকে নিয়ে গোপনে ব্যাড়াতে গেছিলেন, গত কাল রাতে? কোই !? ও আমাকে বলেনি তো ! চেপে গ্যাছে !?! আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে ছিলাম…গভীর ঘুম! ওই ফাঁকে????ছ্যাঃ! না না, এ কী শুনছি! না না, তবুও…শুনি…পুরোটা শুনে নিই…হায় ভগবান।
গৌড়দা ব’ললেন, ” বিয়ের আগে তোমার বৌকে নিয়ে, চুপচাপ, অনেক ঘুরেছি। যাচ্ছেতাই মজা ক’রেছি। কেউ জানেনা। তোমার বৌও খুব আনন্দ, মজা পেতো। অ্যাখোন, এই অ্যাত্তোদিন পর তোমার বৌকে গিয়ে ব’লতে তো খুব খুশি। ব’ললো “আর কেউ থাকবে না। খুব মজা হবে। ”
আমার মাথা ঘুরতে শুরু হয়। ঢোক গিলে ব’ললাম, —” তারপর?”
—-” তারপর, যা হবার তাই.. তোমার বৌ এরও শখ… হ’লো।
— কী শখ হ’লো? বোলুন, খুলে বোলুন।
—তোমার, খেতে।
—খেতে?
—-হ্যাঁ, খেলো! হ্যাংলার মতো খেলো।
আমি কপাল থাপড়াই। কিন্তু গৌড়দার তখন সত্যি কথাটা প্রকাশ করার মুড এসে গ্যাছে। ব’ললেন:-
—অনেক দিন পরে তো। আমিও খেতে থাকি। বেশ ভালো লাগছিলো। কিন্তু তার পর থেকেই, কি ব’লবো ! পাপের ফল! তোমার কি সাংঘাতিক পেটে ব্যথা শুরু হোলো। অ্যাখনো তোমার কোরছে !
ওদিকে তোমার বৌ এর কিচ্ছু হয়নি।
এবার আমি প্রতিবাদ করি,
— কী বলছেন? পেটে ব্যথা?
—-“বিশ্বাস করো, তারপর থেকেই তো তোমার পেট ব্যথা। শালা, ব্যথার চোটে তোমার বাপের নাম খগেন ক’রে দিয়েছে।
আমি তীব্র প্রতিবাদ কোরি। নিজের পেটে হাত বুলিয়ে, অ্যাকটা ছোট্ট থাপ্পড় মেরে, পেটের দুপাশে চিপে ব’ললাম, “কোই, আমার ব্যথা তো ক’রছে না। আপনি রসিকতা ক’রছেন। অ্যামোন রসিকতা ভালো নয়। আর ওই, ‘বাপের নাম খগেন’ কথাটার আমি প্রতিবাদ করছি। এরকম ভাষা শুনে আমি অভ্যস্ত নই। যা যা ব’ললেন, সব মিথ্যে কথা। আমি অপমানিত বোধ করছি। আমার পেটে ব্যথা নেই।”
গৌড়দা থতমত খেয়ে যান। বলেন, “তোমার রাগ ক’রো না। আমি তোমার বাবার কথা তো বোলিনি। উনি তোমার নমস্য ব্যক্তি। আমি তোমার ডাক্তার দেখিয়েছি, বোললেন তোমার অতো ফুচকা খাওয়া ঠিক হয়নি । ফুচকায়, তোমার অ্যাসিড আছে। সেজন্য তোমার ডাইরিয়া হ’য়েছে। আমি ওষুধ খেয়েছি। কিন্তু তোমার পেট ব্যথাটা কমে নি। দাঁড়াও… তোমার আবার পটি পাচ্ছে। তোমার. ..একটু দাঁড়াও। এই রে, আমি… যা, তোমার প্যান্টেই হ’য়ে গ্যাছে…
গৌড়দা টয়লেটের দিকে লেংচিয়ে দৌড় দ্যান। অ্যতোক্ষণে মনে পড়লো, গৌড়দা তো একটু তোৎলা। ওনার কথা কোথাও আটকালে উনি, “তোমার” কথাটা ব’লে কথার সেই হোচটটাকে সামলান। এবং তাতে কথার মানেটা পাল্টে যায়। এটা ওনার অজান্তে তোতলামি কাটাবার অ্যাক মুদ্রা দোষ।
শান্তিতে বাড়ি ফিরে আসি।
অদ্ভুত ব্যাপার! জয়শ্রী বলে, অনেকদিন ফুচকা খাইনা, চলো আজ বিকেলে খেতে যাবো। আমি ব’লি, “ত্তোমার, খাবো না।”
— ক্যানো?
জবাবে বলি:– “ত্তোমার ডাইরিয়া হ’বে। ”
*সত্য ঘটনা অবলম্বনে*
Be First to Comment