পাপিয়া অধিকারী : বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও চিন্তাবিদ্ : কলকাতা, ৮, অক্টোবর, ২০২০। আনন্দবাজারে আজকের দিনের শিল্পী এবং অর্গানাইজার দের মাচা হারানোর দুঃখের কথা পড়লাম। সত্যি শিল্পীর পাশে এখন কেউ নেই ।নিরন্ন হতভাগ্যের পাশে ক্ষমতা না দাঁড়ালেও উপরওয়ালার উপর আমাদের বিশ্বাস এখনো অটুট। সে প্রসঙ্গ পরে হবে খোন। যেটি মনে ব্যথা দেয়, সেটি হলো আমাদের প্রিয় মন্দির কে মাচা বলে অভিহিত করা…মাচায় তো ওঠে শিকারিরা …আমরা তো শিল্পী…শিকার করি না..বিনোদিত করার চেষ্টা করি মাত্র…প্লাটফর্ম টি অত্যন্ত পবিত্র মঞ্চ, ঠিক পড়ছেন, MONCHO, যেখানে দেবতাকেও বসিয়ে পুজো করা যায়, শিল্পীর অভিনয় নাচ গান অন্যান্য পারদর্শিতা দেখে বিনোদিত/অভিভূত হওয়া যায়…প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি শবদেহও বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাচায় করে….কিন্তু… না …।.শিল্পীরা শাশ্বত..আমাদের মৃত্যু নেই…শিকারীও নই ,শবদেহ নই ,শাক ইত্যাদি রাখার আধারও নোই ……তাই নিজেরা যদি নিজেদের সম্ভ্রম করতে না পারি এইরকম একটি কঠিন সময়ে… if our self esteem is in question at this sad hour, where do we stand or so to say, whom we should fight for !!!!!ভাষার ব্যবহার নিজেদের জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে কি ভাল হয় না?????
কয়েকটি অর্থ ‘মাচার ‘….নিম্নম্লিখিত :
মাচা- বাংলার ঘরবাড়ি ও স্থাপত্যের এক প্রাচীন নিদর্শন
বাঁশ দিয়ে নির্মিত উঁচ্চ স্থানকে মাচা বলে। কোথাও কোথাও মাচানও বলা হয়। জলাশয়ের পাশে মাটি থেকে উঁচু, কতগুলি বাঁশের খঁটির উপর; একটি চতুস্কোন বা আয়তকার বাঁশের বাখারী দিয়ে মাচা তৈরী করা হয়। সাঁওতালী ‘মাচট’ (বাঁশ) শব্দ থেকে মাঁচা কথাটি এসেছে। বৃহত্ অংশকে মাঁচা ক্ষুদ্রার্থে ছোক মঞ্চ বলে। সংস্কৃত শব্দ মঞ্চ মানে খাট।
‘যাবে যেদিন শ্মশান ঘাটে বাঁশের দোলায় চড়ে’
এই গানে ‘বাঁশের দোলা’ অর্থাত্ মাচার কথা বলা হয়েছে। লোকগানে শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখা যায়। লোকগানে এর ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে লোকসমাজ থেকে উদ্ভুত এই স্থাপত্যটি যা জনসমাজ বা লোকসমাজের কথা বলে। কারণ আমরা জানি সংস্কৃতি বলতে মানুষের -চিন্তা, কল্পনা, দর্শন, ধ্যান-ধারণা,এই সবকেও বুঝি, যাকে মানব সম্পদও বলা হয়।
গোপাল হালদার যাকে বলছেন -‘ বাস্তব ও মানসিক সমস্ত ‘কৃতি’ বা সৃষ্টি লইয়াই সংস্কৃতি-মানুষের জীবন-সংগ্ৰামের মোট প্রচেষ্টার এই নাম।’ এই কৃতি বা সৃষ্টি কথিটিতে জোড় দিতে চাইছি। নীহাররঞ্জন যাকে ‘কৃষ্টি’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন ‘সংস্কৃতি’। সামগ্ৰিক অর্থে ‘মানুষ’ তার সৃষ্টিকেই তুলে ধরেছে।নৃতাত্ত্বিকভাবে দেখলে মানুষের কৃষ্টি দিয়েই সভ্যতা স্থীরকৃত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থেকে দেখলে সংস্কৃতির তিনটে স্তর। যথা- ক) বাস্তব উপকরণ material means) ,খ) সামাজিক রূপ (social structures) গ) মানবসম্পদ (superstructure)। এখানে আমরা বাস্তব উপকরণের প্রসঙ্গটি যদি নিয়ে আসি তাহলে দেখব, জীবন সংগ্ৰামের জন্য মানুষবাস্তব উপকরণের কাছে সবসময়ই গেছে ও গ্ৰহণ করেছে। সৃষ্টি করেছে নানা কৃষ্টি, তারমধ্যে তার বসবাসের জন্য নির্মিত ঘরবাড়ি ও নানা স্থাপত্যও পড়ে। ঘরবাড়ির প্রাথমিক উপাদান ছিল-বাঁশ, খড়, ঘাস, পাতা, দরমা প্রভৃতি বস্তুসামগ্ৰী।
গ্ৰাম্য চায়ের দোকান বা চৌমাথার মোড়ে, ভেরী বা পুকুরপাড়ে কতগুলি খুঁটির উপর মাচা দেখা। একে মাচা বা মাচান বলে। কোথাও কোথাও ভেরী বা জলাশয়ের পাহাড়া দেওয়া বা রাত্রিযাপনের জন্য ছোট ছোট ঘর করা হয়। রাঢ়বাংলায় একে বলে ‘মাচানতলা’ তলা। চর্তুদিকে দশটি (স্থানভেদে কম বেশি) খুঁটির উপর বাঁশের বাখারী নির্মিত চতুস্কোন মাচা দেখা যায়। মাচা তৈরি হয়েছিল বসবাসের একটি স্থাপত্য রূপে। যা পার্বত্য অঞ্চল, সমভূমি ও নদীচরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করার ঘর হিসাবে। তবে মালভূমি অঞ্চলেও ব্যহার লক্ষ করা যায়। ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রাথমিক মাধ্যম খড়, নলখাগড়া, হোগলাপাতা, নারকেল, তালপাতা, নারকেল দড়ি, বাঁশ, শালবল্লী প্রভৃতি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য মাধ্যম বাঁশ। অন্যদিকে ধান ঝাড়া, পাকা বাড়ি নির্মাণার্থে, চাষের ক্ষেতেও মাচা দেখা যায়, যেখানে ছোট্ট ছোট্ট মাচা করে তাতে বাঁশের খুঁটি রাখতে দেখা যায়। অঞ্চল, ভৌগোলিক অবস্থান, ভূভাগের অবস্থান, মাটির ঘনত্বের উপর নির্ভর করে মাচা। সমস্ত দিক থেকে এগুলিকে অনেকগুলি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- কথায় আছে-‘অন্তিমে কলসী কাঁচা বাঁশের মাচা বুঝি এবার তাও মেলে না।’ শবরপাদের একটি চর্যাগীতিতে মাচায় শবদেহ পোড়ানোর প্রসঙ্গ রয়েছে-
‘চারি বাসে তাভলা রেঁ দিআঁ চঞ্চলী
তঁহি তোলি শবরো ডাহ কএলা কান্দ সগুণশিআলী।’
এখানে চাঞ্চলী মানে চাঁচাড়ি বা বাখাড়ীকে বোঝানো হয়েছে। বাখাড়ী নির্মিত মাচায় শবরকে দাহ করল। পাশে শকুন-শৃগাল কাঁদছে। শবদেহ বহনের জন্য কাঁচা বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করা হয়।মূলত দুটি লম্বা প্রায় আট ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশ নিয়ে পাশাপাশি আড়াই ফুট আড়াআড়ি বাঁশের বাখারী, একবিদ্যা বরাবর নারকেল দড়ি দিয়ে বাধা হয়।মৃতদেহের ওজনের উপর অনেক সময় নির্ভর করে বাখারী ঘন করে বাধার বিষয়টি লক্ষ করা যায়।মোটামুটি ভাবে পাঁচ ফুট থেকে ছয় ফুট মাচাটি করে চর্তুদিকে একফুট করে দুটি বাঁশ ছেড়ে রাখা হয়। কাঁধে রাখা যায়, আর বহনে অসুবিধা না হয়।এই হল শবদেহ বহনের মাচা।
বাংলা প্রাচীনতম সাহিত্য ‘চর্যাপদে’- এ সাঁকোর উল্লেখ পাই।যথা-
‘ ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই
পারগামিলোঅ নিভর তরই।।’
অর্থ-‘ধর্মের জন্য চাটিল সাঁকো গড়ে,পারগামী লোক নিশিন্তে পার হয়।’ এখানে ‘সঙ্কম’ মানে সাঁকো। অন্যদিকে সংস্কৃত শব্দ সংক্রম থেকে সাঁকো কথাটি এসেছে। আঞ্চলিক ভাষায় পুল বা সেতুও বলা হয়। গ্ৰাম বা মফস্বলে সাঁকো নির্মাণের সুলভ উপকরণ বাঁশ। আর তা দিয়ে শক্তপোক্ত সাঁকো গ্ৰামের মানুষ তৈরী করে নেন। চিত্রশিল্পী হরেন দাসের ছবিতে এ বাঁশের সাঁকো দেখা যায়।গুণ চিহ্নের মত করে জলাশয়ে দুটি করে বাঁশ, লম্বায় ছয় বা সাত ফুট (স্থান ভেদে আর ও বেশি হতে পারে) জায়গায় পুঁতে দেওয়া হয়। গুণচিহ্নের মতো, মাঝামাঝি জায়গায় মোটা একটি বৃহত্ দৈর্ঘ্যের বাঁশ দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। যেখানে শেষে সেখানে আবার অন্য একটি বাঁশ বাঁধা হয়।এছাড়া আড়াআড়ি তিন-চার ফুট দৈর্ঘ্যের মাচার সাঁকো তৈরি করা হয়, নীচে দুদিকে, জলাশয়ে ঘন ঘন বাঁশ বেধে মাচার মত করে।
কোনো জনপদ বা গ্ৰামের প্রান্তদেশে চারটে বড় বড় বাঁশের চারকোনা ভাবে পোঁতা হয়। এর অনেক উপরে মাচা করা হয়। তার উপরে দুদিকে, কোনও জায়গায় তিনদিকে ঢালু খড়ের চাল ছাওয়া হয়, বর্ষার জলের হাত থেকে রক্ষার জন্য। এই মাচান গুলিতে মূলত গ্ৰামের বা কোনো অঞ্চলের সুরক্ষার্থে রাত্রে দু-একজন লোক রাত জেগে এখানে বসে পাহাড়া দেন। বিপদ দেখলে গ্ৰামের লোককে অবগত করান। আবার বনদপ্তরে মাচানটির চতুর্দিক ঘেরা থাকে। এখানেও পশুর বিপদ, বন্য শিকারীদের পর্যবেক্ষনের জন্য এ ধরনের মাচান তৈরি করা হয়।
মধ্যযুগে রাজপুত বা মুঘল মিনিয়েচার বা অনুচিত্র গুলিতে পায়রা বসার মাচার দৃশ্য দেখা যায়। যা প্রাসাদের ছাদের এককোনে একটি দীর্ঘ বাঁশের উপর ছোট ছোট বাঁশের বাখারী দিয়ে তৈরি চতুস্কোন মাচা দেখা যায়। আধুনিক টিভির আন্টেনা সদৃশ দেখতে। একটা শক্তপোক্ত বাশের মাথার দিকটি সমান চারভাগে চিরে(ফেড়ে)নিয়ে, চারটি বাখারীর শির্ষদেশে ছোট মাচাটি দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। আজ থেকে দুশ-তিনশো বছরের পুরনো ফটোগ্ৰাফে এ ধরনের মাচা বাড়ির পাশে দেখা যায়। গ্ৰামে বা মফস্বলে এমনকী শহরে যারা পায়রা পোষেন তারা এই মাচা তৈরি করেন।
নৌকায় যে জায়গাগুলিতে লোক বসে তা বাঁশের মাচার মত। পরে উপরিভাগে অর্থাত্ গুড়োর উপরে যে বাঁশের ঘন স্থির থাকে তা মাচাসদৃশ। গুড়ো – নৌকা তৈরীর সময় নৌকার মাথা থেকে দুপাশে’ডালির’ সঙ্গে সংযোগ রেখে, ডালা না ছাড়ার জন্য ২/১ হাত অন্তর যে শক্ত কাঠ এড়ো ভাবে লাগানো থাকে। এরপর হল চলাচল বা নৌকা থেকে ওঠানামার জন্যও মাচা ব্যবহৃত হয়।এগুলি ১০ফুট/২ফুট দৈর্ঘ্যের একটি লম্বাসদৃশ নির্মিত হয়।
সাধারণত জয়াল ভয়ের জন্য এধরনের মাচা ব্যবহার করা হয়। জয়াল ভয় হল-নদীর তীরবর্তী ভূমি যা, নানা সময়ে ভেঙ্গে যায়। সেই বিপদ শঙ্কুল সেই পাড়ে পাড়াপাড়ের সুবিধার্থে ও নীচু ভূভাগে নামতে মাচার ব্যবহার হয়। আঞ্চলিক ভাষায় বলে ডালা। অন্যদিকে বালি নিয়ে যাওয়ার জন্য বৃহত্ একধরনের নৌকা ব্যহৃত হয়ে থাকে। এ সমস্ত নৌকায় নদীপাড়ের পলি বা বালি তোলার জন্য প্রায় ৬ ফুট/১০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশের শক্তপোক্ত মাচা নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি দুই থেকে তিনজন যাতায়াত করতে পারে ও নৌকায় ঝুড়ি দিয়ে বালি নৌকায় ফেলতে পারে। মাচায় আড়াআড়ি যে বাখাড়ীগুলি অর্ধেক বাঁশ দিয়ে নির্মিত হয়,ভারবাহী হয়ে ওঠার জন্য।
গরুগাড়ির চাকা বাদে প্রায় সিংহভাগটাই বাঁশ দিয়ে তৈরি। যেখানে ছৌঘর বা মালপত্র নিয়ে যাওয়ার জায়গার প্রান্তদেশ থেকে গাড়োয়ানের বসার জায়গা পর্যন্ত শকট আকৃতির জায়গাটির পুরোটাই মাচা যা বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়।
Be First to Comment