স্মরণঃ আ ম জা দ খা ন
বাবলু ভট্টাচার্য : জলপাই সবুজ রঙের ধূসর বসন, একটি পিস্তল, ছোট আংটি একটি, দাড়ি ভর্তি একটি অপরিচ্ছন্ন মুখ আর তার সঙ্গে একজোড়া জুতো– যা যতবার আওয়াজ করে ততবারই যেন হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালের কথা বলছি। আর, সেই সময় তো দুষ্ট লোক বলতে একটা মুখই চোখের সামনে ফুটে উঠত- গব্বর সিং তথা আমজাদ খান।
১৯৪০ সালের ১২ নভেম্বর আমজাদ খান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক পশতুন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন জয়ন্ত, যিনি ছিলেন তৎকালীন বলিউডি চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ।
১৯৫১ সালে ‘নাজনিন’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে আমজাদ খানের চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু হয়। সে সময় তিনি ছিলেন শিশুশিল্পী। তিনি প্রথম বড় সুযোগ পান ‘শোলে’ ছবিতে গাব্বার সিংয়ের ভূমিকায়।
ছবিটির চিত্রনাট্যকার ছিলেন সেলিম- জাভেদ জুটি। সেলিম খান তাঁকে এই ভূমিকায় পছন্দ করেন। তাঁর জন্য সুপারিশ করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন।
১৯৭৫ সালে ‘শোলে’ মুক্তির পর গাব্বার সিং-এর চরিত্রটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ‘শোলে’তে ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ, সঞ্জীব কুমারের মতো তারকাদের সঙ্গে শুধু সমান তালেই অভিনয় করেননি আমজাদ বরং সব আলো কেড়ে নেন নিজের দিকে। নায়ক জয় ও ভিরুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয়তা পায় গাব্বার।
গাব্বারের উচ্চারিত ‘কিতনে আদমি থে?’, ‘ইয়ে হাথ মুঝে দে দে ঠাকুর’, ‘জো ডর গায়া, সমঝো মর গায়া’ ইত্যাদি সংলাপ লোকের মুখে মুখে ফেরে। ‘শোলে’র পর অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে দেরি হয়নি তাঁর। একের পর এক ছবিতে খলনায়ক হয়ে পর্দায় দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে থাকেন।
১৯৭৭ সালে তিনি অভিনয় করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার এক চরিত্রে। সত্যজিৎ রায়ের ক্ল্যাসিক ছবি ‘সতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে আওধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে। আওধ বা লক্ষ্ণৌর শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি ছিলেন কবি, সঙ্গীতানুরাগী এবং অভিমানী।
এই জটিল চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান আমজাদ খান।
১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘মুকাদ্দার কা সিকান্দার’। এ ছবিতে নায়ক ছিলেন অমিতাভ বচ্চন আর খলনায়ক দিলওয়ারের চরিত্রে ছিলেন আমজাদ খান। এখানেও তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি। দিলওয়ার শুধু সাধারণ খুনে গুন্ডা নয়, সে পাগল প্রেমিকও বটে।
‘ইনকার’, ‘দেশ পরদেশ’, ‘নাস্তিক’, ‘সাত্তে পে সাত্তা’, ‘দাদা’, ‘চম্বল কি কসম’, ‘নসিব’, ‘গঙ্গা কি সৌগান্ধ’, ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ ইত্যাদি ছবিতে খলনায়ক রূপে দেখা যায় তাঁকে।
‘লাওয়ারিস’ ছবিতে ব্যতিক্রমী ভূমিকায় পর্দায় আসেন তিনি। ছবির প্রথমে এক ধনী লম্পট এবং পরের অংশে ত্যাগী ও দয়াবান ভূ-স্বামীর চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। এখানে অমিতাভ বচ্চনের বাবার ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এই সময়ে বেশ কিছু ছবিতে তাঁকে ইতিবাচক ভূমিকায় দেখা যায়। ‘ইয়ারানা’ ছবিতে অমিতাভের বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেন আমজাদ খান।
‘কুরবানি’ ছবিতে তীক্ষ্ণ ও রসবোধ সম্পন্ন এক পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে আমজাদ খান চমক সৃষ্টি করেন। কুমার গৌরব-ভিজেতা পণ্ডিত অভিনীত হিট ছবি ‘লাভস্টোরি’তে বন্ধুভাবাপন্ন পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে হাসির ছবি ‘চামেলি কি শাদি’-তে অনিল কাপুর, অমৃতা সিং এবং আমজাদ খান দারুণ কমেডি উপহার দেন দর্শককে।
প্রায় কুড়ি বছরের ক্যারিয়ারে তিনি ১৩০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত বিখ্যাত ছবির মধ্যে আরও রয়েছেঃ ‘হিম্মতওয়ালা’, ‘দেশপ্রেমী’, ‘লেকিন’, ‘রুদালি’, ‘লাভ’, ‘পালকো কি ছাওমে’, ‘পারভারিস’, ‘বেশরম’, ‘হীরালাল পান্নালাল’, ‘কাসমে ওয়াদে’, ‘বারসাত কি এক রাত’, ‘ফুল খিলে হ্যায় গুলশান’, ‘মি: নটবরলাল’, ‘সুহাগ’ ইত্যাদি।
১৯৮৬ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। চিকিৎসার অংশ হিসেবে তাঁকে যেসব ওষুধ গ্রহণ করতে হয় তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় বিপদজনকভাবে তাঁর ওজন বেড়ে যায়। এই বাড়তি ওজনই তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে।
আমজাদ খান ১৯৯২ সালের আজকের দিনে (২৭ জুলাই) মাত্র ৫১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment