সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা,৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের বহু দেশে নারী দিবসকে স্বীকৃতি জানিয়ে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।দেশগুলির তালিকায় আছে আফগানিস্থান, আর্মেনিয়া,আজারবাইজান,কম্বোডিয়া, কিউবা, মঙ্গোলিয়া,উজবেকিস্তান, উগান্ডা, ভিয়েতনাম, রাশিয়া সহ অনেক দেশ। আবার চিন,নেপালসহ কিছু দেশ আছে যেখানে মহিলা কর্মীরা সবেত ন ছুটি পান।কিন্তু ভারতে নারী কর্মীরাও এই ছুটি থেকে বঞ্চিত। ছুটি বিষয়টি অত গুরুত্বপূর্ণ নয়,ছুটি একটি প্রতীকী।
নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি।সমাজে অর্ধেক আকাশের স্বীকৃতি।ভারতে নারীরা সেই স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত।শাসক বিরোধীদলের কোনও মহিলা নেত্রী বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না ।এই প্রতিবেদক বহু নারী কর্মীকে ৮মার্চের তাৎপর্য প্রসঙ্গে জানতে চায় ।কিন্তু কেউ সদর্থক জবাব দিতে অপারগ জানিয়েছে।
নারী প্রগতির কথা যাঁরা বলেন তাদের এই নারী দিবস সম্পর্কে অজ্ঞতা রীতিমতো পীড়াজনক।
অথচ আধুনিক বিশ্বে নারী প্রগতির উত্তরণে ৮মার্চ দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে।ইতিহাসটা জানতে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯০৯ সালে।সে বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম এক আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়।
এই সম্মেলনের সূত্রপাত নারী শ্রমিকের শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ থেকে।শিল্প বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তে ১৮৫৭সাল থেকে মজুরি বৈষম্য, বেহিসেবী কর্মঘণ্টা ও কাজের অমানবিক পরিবেশে শোষিত হচ্ছিলেন নারীকর্মীরা।প্রতিবাদ প্রতিরোধ হয়ে ওঠে এই নারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে।বিদ্রোহ ক্রমশ সংঘবদ্ধ হয়।
১৯১০সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে হয় দ্বিতীয় সম্মেলন।বিশ্বের ১৭টি দেশ থেকে ১০০নারী প্রতিনিধি যোগ দেন।এই সম্মেলনে নেত্রী ক্লারা প্রস্তাব রাখেন প্রতি বছর ৮মার্চ দিনটি বিশ্বব্যাপী নারী দিবস পালনের। ঠিক হয় ১৯১১থেকে এই দিনটি নারী সমানাধিকার দিবস হিসেবে পালন হওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশেও ১৯৭১সালের স্বাধীনতার আগে থেকেই এই দিবসকে স্বীকৃতি জানিয়ে পালন করে আসছে।এরপর আসে সেই স্মরণীয় মুহূর্ত। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ১৯৭৫ সাল থেকে ৮মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়। মূলত বিশ্ব জুড়ে নারীর সমানাধিকারের স্বীকৃতি দেটাই রাষ্ট্রসংঘের এই ঘোষণা।
এই বছরের নারী দিবসের প্রেক্ষিতে বিশ্বে নারীদের অবস্থা কি ? কতটা পরিবর্তন হয়েছে?
ছবিটা কিন্তু আশাপ্রদ নয়।ইন্টারন্যাশানাল লেবার অর্গানাইজেশন এর রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নারীদের শ্রমের জোগান কমছে।
ভারতে ২০১৩_১৪ তে যা ছিল ৩১.১০%,২০১৫_১৬তে কমে হয়েছে ২৭.৪০%।নিয়োগকর্তা এক দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও একজন পুরুষকে যোগ্য মনে করেন এবং নিয়োগ করেন।আবার যদি নারী কর্মী নিয়োগও করেন সেক্ষেত্রে মহিলা কর্মী বা শ্রমিককে দেন কম মজুরি ।যা লিঙ্গবৈষম্য।
অন্যদিকে এটাও দেখা যাচ্ছে ভারতে নারীরা বিয়ের পর চাকরি কখনও স্বেচ্ছায় বা কখনও সংসারের দায়িত্বকে গুরুত্ব দিতে চাকরি ছেড়ে দেন। কিম্বা যোগ্যতা ও সুযোগ থাকলেও প্রমোশন নেন না।
পাছে সন্তান পালনে ব্যাঘাত ঘটে। এই স্বেচ্ছা শব্দেও রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে। কেননা বাড়ির চেপে বা সমাজের চাপে মেয়েরা যোগ্যতা থাকা সত্বেও শ্রমের বাজার থেকে নিজের অধিকার নিজেই নেয় না।
ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট সার্ভে দেশের দু লক্ষ মানুষের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেখেছে পরিবারের মধ্যে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যত কম হবে সেই পরিবার তত পুরুষতান্ত্রিক ।
১৯৬১ সালে ভাবী মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পেতেন১২ সপ্তাহ। ২০১৭ তে তা বাড়িয়ে ৬মাস করা হয়েছে। যদিও এই নিয়ম বেসরকরিভাবে সংস্থাগুলির অনেকে মানে না। নানা কারণে তাই মেয়েরা কাজ নয়ত মাতৃত্ব বেছে নেয়।
আমেরিকার মত দেশে নারীর ভোটাধিকার আদায় হয়েছে মাত্র একশো বছর হলো।
ইংল্যান্ডে নারী সে অধিকার পায় আরও দু বছর আগে। এদেশেও নারী ভোটাধিকার পেযেছেন ১৯৩৫ সালে। সমীক্ষা বলছে, ভারতে নারী কর্মসংস্থান জি ২০দেশগুলির মধ্যে নারী অধিকার লঙ্ঘনে সৌদি আরবের পর ভারতের স্থান। গ্রামাঞ্চলে নারী শ্রমিক কমছে শহরের তুলনায়। বরং বাংলাদেশের নারীরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে।
অবাক করার বিষয় ভারতের মেয়েরাও বিশ্বাস করে মেয়েদের তুলনায় পুরুষের রোজগার বেশি প্রয়োজনীয়। ভারতে নারী বিধায়ক, সাংসদ,রাজ্যপাল ,মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতির পদও সামলেছেন এখনও সামলাচ্ছেন যোগ্যতার সঙ্গে । কিন্তু সাক্ষরতার হারে ভারতের নারী আজও অনেক পিছিয়ে পুরুষের তুলনায়।
সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রেও নারী পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পায় নামমাত্র ক্ষেত্রে। এমন বহু অসাম্যের শিকার এদেশের মেয়েরা। সাম্প্রতিক সার্ভে বলছে, নারীদের জন্য বিপদজনক দেশের তালিকায় ভারতের স্থান আফগানিস্থান, সিরিয়া,সোমালিয়া, পাকিস্থান ও কঙ্গোরও আগে। অর্থাৎ যে দেশগুলি দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধে জেরবার মহিলারা নিপীড়িত, ইসলামিক রক্ষণশীলতার নামে নিষ্ঠুরতায় অমানবিক নারী নির্যাতনের প্রথম সারিতে সেইসব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।
সমীক্ষা বলছে ২০১৫সাল পর্যন্ত এদেশে প্রায় ২ লক্ষ মহিলা শ্লীলতাহানি ও যৌন নির্যাতনের ভীতিতে চাকরি ছেড়েছেন। প্রতি ৬৮মিনিটে একটি মেয়ে পণের জন্য আত্মহত্যা করছেন।
শুধু নারী নন, শিশুকন্যারাও নিরাপদ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের বা প্রতিবেশী পুরুষের ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ছবি- প্রতীকী। লেখার সাথে সম্পর্কিত নয়।
Be First to Comment