জন্মদিনে স্মরণঃ চি নু য়া আ চে বে
বাবলু ভট্টাচার্য : আধুনিক আফ্রিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, নাইজেরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, বিশ্বসাহিত্যেরই এক শ্রদ্ধেয় মানুষ চিনুয়া আচেবে।
নাইজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের এঙ্গলিকান মিশনারিদের গোড়ার দিককার স্থাপিত গীর্জাসমূহের একটি ছিল ওগিডি গ্রামে। এখানেই আচেবের শৈশব কাটে এবং তিনি ইবাদানের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইংরেজীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
সে সময়কার শিক্ষায় পশ্চাৎপদ আফ্রিকায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেই একজন মানুষ সমাজের উচ্চস্তরের বাসিন্দা বলে গণ্য হতেন, তাকে ভাবা হতো আলোকিত।
প্রথম জীবনে রেডিও ঘিরে গড়ে ওঠা পেশাটির পরিসমাপ্তি ঘটে যখন ১৯৬৬ সালে জাতীয় জাগরণের উত্তাল দিনগুলোতে, যা পরিশেষে বায়াফ্রান যুদ্ধে গিয়ে গড়ায়, তিনি সহসাই চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বায়াফ্রার তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক ও তহবিল সংগ্রহের উদযোগে বায়াফ্রার প্রতিনিধিত্ব করেন। এ সময়ে তাকে নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ দেওয়া হয় এবং তিনি দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
যে উপন্যাস তাকে ভুবনজোড়া খ্যাতি এনে দেয় তার নাম ‘থিংস ফল এ্যাপার্ট’ (সবকিছু ভেঙে পড়ে)। বইটি ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে আর কমপক্ষে এর এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এই বইটির জন্য তিনি ২০০৭ সালে ম্যানবুকার পুরস্কার লাভ করেন। এ উপন্যাস যখন লেখেন তখন আচেবে সাতাশ বছরের এক টগবগে যুবক, নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রযোজক হিসেবে কর্মরত।
দু’বছরের একনিষ্ঠ লেখা ও নিরন্তর পরিমার্জনার পরে পান্ডুলিপিটি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটেনের এক প্রকাশনা সংস্থায়— যারা বিনামূল্যে তরুণ লেখকদের প্রতিশ্রুতিপূর্ণ পান্ডুলিপি টাইপ করে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কিছুকাল ব্রিটেন থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তিনি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হন এবং ভয় পাচ্ছিলেন সম্ভবত তার অনেক শ্রমের ও মেধার ফসলটি হারিয়ে গেছে। পরে আচেবের এক পরিচিতজন ব্রিটেন থেকে টাইপকৃত পান্ডুলিপিটি উদ্ধার করেন এবং সেটি উইলিয়াম হেইনম্যান প্রকাশনী থেকে ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই উপন্যাসটি সাড়া ফেলে।
যে সম্প্রদায়ে আচেবের জন্ম সেই ইগবো সম্প্রদায়ের কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘থিংস ফল এ্যাপার্ট’।
উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছে অকুনকো নামের এক সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও কুস্তিগীর— যার খ্যাতি পশ্চিম আফ্রিকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভুল করে সে যখন একজন অভিজাত শ্রেণির মানুষকে খুন করে ফেলে দৃশ্যপট পাল্টে যায় আর তার জগতের সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করে। অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে অকুনকো দেখতে পায় তার গ্রামে মিশনারীর ধর্মযাজক থেকে শুরু করে উপনিবেশিক শাসকদের প্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছে তার শাস্তিবিধানে।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় ‘নো লঙ্গার এট ইজ’ (স্বস্তি নেই আর)। এ দু’টি বই আর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘এ্যারো অব গড’ (দেবতার ধনুর্বান) নিয়ে গড়ে উঠেছে আচেবের ট্রিলজি— আফ্রিকান সাহিত্যের যা অন্যতম সেরা সম্পদ।
‘থিংস ফল এ্যাপার্ট’ ম্যানবুকার পুরস্কার প্রদানের সময়ে আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ওলে সোয়েঙ্কা— যিনি পুরস্কারপ্রদান কমিটির একজন সদস্য ছিলেন, আচেবের এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখেন— ‘ইংরেজীতে এটিই প্রথম উপন্যাস— যা একটি আফ্রিকান চরিত্রের অন্তঃস্থল থেকে কথা বলে, একজন সাদা মানুষের চোখে আফ্রিকার যে বর্ণিল চিত্র তা থেকে যা একেবারেই আলাদা’।
আচেবের উপন্যাস আফ্রিকার হৃদয় থেকে, কালো মানুষদের চোখ দিয়ে দেখা শোষণ ও বৈষম্যের আফ্রিকা, আফ্রিকার গোলযোগপূর্ণ রাজনীতি, উপনিবেশিক শাসকদের বিভিন্ন অপতৎপরতা ও কূটকৌশল এবং পশ্চিমা বিশ্বের চোখে আফ্রিকার যে ছবি— তা আচেবের লেখায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে, বিভিন্নভাবে বিধৃত হয়েছে।
কোয়ামে এন্থনি আপাইয়া আচেবেকে ইংরেজী ভাষায় আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের জনক বলে সম্বোধন করেছেন। আরেক নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক নদিন গর্ডিমার বলেন, তিনি এমন একজন লেখক যার কোনো বিভ্রান্তি নেই এবং তিনি নিজে বিভ্রান্ত নন, নিজেকে অনুকম্পা না করেই যিনি তার জনগণকে ভালোবাসেন, যিনি এক মহৎ, উদার প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন।
অসামান্য সাহিত্যসৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ চিনুয়া আচেবে তার জীবনে অসংখ্য সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মাঝে রয়েছে আমেরিকান একাডেমী অব আর্টস এন্ড লেটারসের সম্মানিত ফেলো, বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্যের জন্য নাইজেরিয়ার সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ম্যানবুকার পুরস্কার তার সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। ২০১০ সালে তিনি ডরোথি আ্যান্ড লিলিয়ান গ্রিস পুরস্কার পান।
সামরিক সরকার দু’বার তাকে নাইজেরিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক জাতীয় সম্মাননা ‘কমান্ডার অব দ্য ফেডারেল রিপাবলিক’ প্রদান করতে চাইলেও আজীবন ম্বৈরাচারী শাসকদের স্বৈরশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আচেবে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন।
বিশ্বের ত্রিশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে গৌরবান্বিত করেছে। এ সবই অসামান্য প্রতিভাবান এক সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি।
২১ মার্চ, ২০১৩ এই মহান লেখক বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস, যুক্তরাষ্ট্র মৃত্যুবরণ করেন।
চিনুয়া আচেবে ১৯৩০ সালের আজকের দিনে (১৬ নভেম্বর) নাইজেরিয়ার ওগিডিতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment