জন্মদিনে স্মরণঃ প ণ্ডি ত য শ রা জ
“আগের দিনের রাগসংগীত যদি হিমালয়ের মতো সুউচ্চ হয়, তবে এখনকার সংগীত সমুদ্রের মতো সুবিস্তৃত।”
——- পণ্ডিত যশরাজ
বাবলু ভট্টাচার্য : ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি একবার এক আয়োজনে আমন্ত্রণ করলেন পণ্ডিত যশরাজকে। তখন ছিল মে মাস, রাত ছিল পূর্ণিমার, আকাশও পরিষ্কার। কিন্তু যশরাজের সেদিন খুব ধুলিয়া মালহার গাইতে ইচ্ছা করছে। বর্ষার আগে ধূলিঝড় হয়, তারপর বৃষ্টি নামে— এর সুর নিয়েই রাগ ‘ধুলিয়া মালহার’। যশরাজ গাইতে শুরু করলেন। ২০ মিনিটের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ধূলিঝড়, তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টি! বাজপেয়ি সেদিন যশরাজের নাম দিলেন ‘রসরাজ’। তাকে বলা হতো একালের ‘তানসেন’।
আট দশকেরও বেশি সময় ধরে সংগীত সাধনা করেছেন পণ্ডিত যশরাজ। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বসংগীতের দরবারে। জন্ম দিয়েছেন রূপকথার মতো নানা ঘটনার।
তার বাবা পণ্ডিত মতিরামও ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একনিষ্ঠ সাধক। তার কাছেই সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি যশরাজের। মেওয়াতি ঘরানার গায়ক পণ্ডিত যশরাজ।
পিতার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পণ্ডিত মণিরাম যশরাজের ইচ্ছানুসারে তাকে কণ্ঠসঙ্গীতেই তালিম দেন এবং ১৪ বৎসর বয়সেই কণ্ঠ সঙ্গীতে পারদর্শিতা অর্জন করেন।
যশরাজ তার তারুণ্যের বেশিভাগ সময়ই হায়দ্রাবাদে কাটান এবং সেখান থেকে গুজরাতের সানন্দে যাতায়াত করতেন মেওয়াতী ঘরানা শিখতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতপ্রিয় ঠাকুর সাহেব নামে পরিচিত সানন্দের মহারাজ জয়ন্তসিং বাঘেলার জন্য যশরাজ সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন এবং তার কাছেও তালিম নেন।
১৯৪৬ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ঠিক আগে কলকাতায় যান তিনি। রেডিওতে গাইতে শুরু করেন ধ্রুপদি গান। ১৪টি বছর কলকাতায় ছিলেন বলে পণ্ডিত যশরাজ বাংলা বলতেন খুব ভালো।
১৯৫২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে নেপালের রাজা তিরুভান বীর বিক্রম শাহের দরবারে গান করেন তিনি।
একবার কাশীর একটি মন্দিরে যশরাজ গাইছিলেন রাগ তোড়ি। প্রচণ্ড ভিড় ছিল সেদিন। যশরাজের গান শুনে ভিড় ঠেলে মঞ্চের কাছাকাছি চলে এল একটি হরিণ। তার গান শেষে চলে যায় হরিণটি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন পণ্ডিত যশরাজ। সেবার বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭-তে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ডিসেম্বর মাসের এক শীতসকালে যশরাজ-কন্যা দুর্গা যশরাজ বাবার সংগীতজীবনের এ গল্পগুলো শুনিয়েছিলেন।
মেওয়াতি ঘরানার এই গায়ক খেয়াল গানের জন্যই গোটা বিশ্বে সুপরিচিত। খেয়াল গানে এক অনন্য নিজস্বতা এনেছিলেন যশরাজ। তার খেয়ালে ছিল ঠুমরির প্রভাব। যে কারণে শুরুর দিকে তাকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়। নানাভাবে বারবার নিজেকে ভেঙে, নিরীক্ষা করে এগিয়েছেন তিনি। আবিরী তোদী, পটদীপাক্ষীর মতো অল্প পরিচিত ও অনেক প্রচলিত রাগকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন পণ্ডিত যশরাজ।
আটলান্টা, ভ্যাঙ্কুভার, টরন্টো, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সির মতো শহরের বিভিন্ন স্কুলে নিয়মিত সংগীত শিক্ষা দিয়েছেন পণ্ডিত যশরাজ। তার কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন সাধনা সারগম, অনুরাধা পাড়োয়াল, কলা রামনাথ, রমেশ নারায়ণ প্রমুখ।
তার দুই ভাই পণ্ডিত প্রতাপ নারায়ণও শাস্ত্রীয় সংগীতের এক মহান শিল্পী, যার দুই ছেলে যতীন-ললিত পরে সংগীত পরিচালক হিসেবে বলিউডে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। অন্যদিকে বেগম আখতার ছিলেন যশরাজের সংগীতের অনুপ্রেরণা।
সংগীতে অবদানের জন্য পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী সম্মাননা অর্জন করেছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
ভারতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রথম এক দুর্লভ সম্মানে সম্মানিত হন পণ্ডিত যশরাজ। গত বছর মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পণ্ডিত যশরাজের নামে একটি গ্রহের নামকরণ করে। গ্রহটির নাম দেওয়া হয় ‘পণ্ডিত যশরাজ (৩০০১২৮)’। ছোট ওই গ্রহটিকে ২০০৬-এর ১১ নভেম্বর খুঁজে পাওয়া যায়। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যে একটি গ্রহাণুপুঞ্জে গ্রহটির অবস্থান। এর আগে তার নামে একখণ্ড চাঁদের নামও রাখা হয়েছিল।
কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে পণ্ডিতজি ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট আমেরিকার নিউ জার্সিতে প্রয়াত হন।
পণ্ডিত যশরাজ ১৯৩০ সালের আজকের দিনে (২৮ জানু) হরিয়ানার হিসারে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment