Press "Enter" to skip to content

আজ শক্তির দেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে গোটা বাংলা সহ এই দুনিয়া…..।

Last updated on October 25, 2022

Spread the love

** আজ শক্তির দেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে গোটা বাংলা, কিন্তু এই দেবীর সম্পর্কে আমরা অনেকে অনেক কিছুই জানি না। তাই পুজোর আগেই সংক্ষেপে সেই সব অজানা তথ্য জেনে নেওয়া যাক।**

সঙ্গীতা চৌধুরী : ‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের  স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ ‘। হিন্দু মহাকাব্য ‘মহাভারত’ – এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে , তা দেবী দুর্গারই একটি রূপ। ‘মহাভারত’ – এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী ‘ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যিনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘কাল’ শব্দের সাধারণত দুটি অর্থ রয়েছে ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু এক্ষেত্রে এই শব্দের মানে ” সময়ের থেকে উচ্চতর “। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’ সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। তবে প্রকৃত অর্থে কালকে রচনা করেন যিনি তিনিই কালী।

সনাতন ধর্মমতে কালী বা কালিকা হচ্ছেন শক্তির দেবী। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভয়ংকরের পূজা করেন। মা কালী অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করেন। শাক্ত সৃষ্টিতত্ত্ব মতে এবং শাক্ত- তান্ত্রিক বিশ্বাস মতে তিনিই পরম ব্রক্ষ্ম। কালীকে এই সংহারী রূপের পরেও আমরা মাতা সম্বোধন করি। কারন সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি সন্তানের কল্যাণ চান তিনি মঙ্গলময়ী এবং কল্যাণী। হিন্দু শাস্ত্রে বলা আছে যে, তন্ত্র মতে যে সব দেব- দেবীর পুজো করা হয়, তাঁদের মধ্যে কালী পুজো অন্যতম।

শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ঙ্কর রূপ সৃষ্টির পেছনে এক পৌরাণিক কাহিনী আছে। কালিকা পুরান থেকে জানা যায় পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামে দুই রাক্ষস সারা পৃথিবী জুড়ে সে সময় ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলেন। এই দুই রাক্ষস ভ্রাতাদ্বয় পৃথিবীতে চরম অত্যাচার শুরু করেছিলেন। তাদের আক্রমণের পরিধি শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, দেবলোকের ওপরও আক্রমণ চালান। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। ফলে দেবলোক তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। কথিত আছে এই পরিস্থিতিতে দেবতারা ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরণাপন্ন হন। তাঁরা উপদেশ দেন  সকল দেবতারা মিলে যেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার  উপাসনা করেন। ফলে দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যাশক্তি মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন। তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে আবির্ভূত হন। মা মহামায়া অবতীর্ণ হলে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তাঁর রুদ্র রূপ ধারণ করে। এই সময়ই মহামায়ার  শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হন, যিনি কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। মা মহামায়া সেই সময় কালো বর্ণ ধারণ করেন, যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে গন্য করা হয়।

কালীপুজো বা শ্যামা পুজো একটি হিন্দু উৎসব। বাংলায় গৃহে বা মন্দিরে মা কালীর মূর্তির নিত্য পুজো হয়ে থাকে। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত দীপান্বিতা কালীপুজো বিশেষ জনপ্রিয়। এই দিন সারারাত ব্যাপী কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয় আলোকসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মাধ্যমে। দ্বীপান্বিতা কালীপুজোর দিনটিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। তবে এই দিন অনেকে লক্ষী পুজোও করে থাকেন। তাছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে ফলহারিনী কালীপুজোর বিশেষ জনপ্রিয়। ব্রক্ষ্মযামল তন্ত্রগ্রন্থের মতে, মা কালী হলেন বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অনেক স্থানে প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে মায়ের পুজো হয়।


তবে কালীপুজোর সঙ্গে প্রদীপ জ্বালানোর কি সম্পর্ক ? কথিত আছে , মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে সূচনা হয় দেবী পক্ষের। ঐ দিন পিতৃপুরুষদের তর্পণ করার প্রথা প্রচলিত আছে। পিতৃপক্ষের সময়ের বিদেহী আত্মারা মর্ত্যে জল গ্রহনের জন্য এসে এখানেই থেকে যান। দীপাবলির সময় তাঁরা পিতৃলোকে ফিরে যান। কিন্তু দীপাবলির দিনটি থাকে অমাবস্যা। তাই অন্ধকারে যাতে তাঁদের ফিরে যেতে অসুবিধা না হয়, তারজন্যই ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে রাখা হয়। তবে ঐ দিন লক্ষীপুজো পালিত হওয়ার পেছনে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের স্মার্ত পন্ডিত ও নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষীপুজোর বিধান দেন।

দীপাবলির এই আলোক মালার উৎসবের পেছনে আরো একটি কারনের উল্লেখ পাওয়া যায়, মা কালী সাক্ষাৎ ব্রক্ষ্মময়ী। তিনি আমাদের অবিদ্যা রূপী অন্ধকার দূর করে জ্ঞান দেন ও চেতনা দেন। তাঁর আবির্ভাবে অন্ধকারময় অবিদ্যা ও অশুভ শক্তির নাশ হয়ে যায়। তাই কার্তিক মাসের অমাবস্যায় আমরা প্রদীপের অলোকমালায় সেই জগত মাতাকে বরন করে নেই। অমাবস্যার রাতে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পুজো করা হয়। পুরানে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষা কালী, গ্রহ কালী, চামুন্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। এছাড়াও দেবী কালীর  একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আগেকার দিনে, দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উৎসর্গ করা হয়। এছাড়াও প্রসাদ হিসেবে নানা ফল এবং  লুচি ভোগ দেওয়া হয়। কালীপুজোতে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগল বা মহিষ বলি দেওয়া হত। তবে বর্তমানেও বহু জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পুজোর প্রচলন দেখা যায়। বহু আগে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালীপুজো করত বলে শোনা যায়।

ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের স্মার্ত পন্ডিত রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষীপুজোর বিধান দিলেও, কালী পুজোর কোন উল্লেখ করেন নি। সপ্তদশ শতকে বাংলায় কালীপুজোর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এরপর অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত কালী সপর্যাস বিধিতে প্রথমবার দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। রামপ্রসাদ সেনের গুরু নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকেই বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপুজোর প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। এর আগে কালীর উপাসকরা তামার পটে খোদাই করে বা ছবি এঁকে মা কালীর পুজো করতেন। জানা যায় অষ্টাদশ শতকে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপুজোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই ভাবে মা কালীর প্রতিমা পুজোর প্রচলন শুরু হয় বাংলায়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের ভক্তিতে কালীপুজো দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কালী পুজোয় আজও কোথাও কোথাও পাঁঠাবলী দেওয়া হয়। কিন্তু এ রকম প্রথার প্রচলন কেন হল ? এ ব্যাপারে জানা গেছে যে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মতে মা কালী সব সময় উলঙ্গ থাকতেন। তাই তিনি দিনে বেরতেন না, রাতেই বের হতেন। একদিন তিনি রাতের বেলা বনের মধ্যে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে সকাল হয়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তায় পড়ে যান যে তাকে বস্ত্রহীন অবস্থায় যদি মানুষ দেখে ফেলে তাহলে খুবই লজ্জা পাবেন। এই সময়ই তিনি দেখতে পেলেন একটি যুবক ছাগলের পাল নিয়ে যাচ্ছে। মা কালী তখন ছাগীর রূপ ধরে সেই ছাগলের পালের মধ্যে প্রবেশ করলেন। কিন্তু সেই ছাগলের পালের মধ্যে একটি পাঁঠা মা কালী রূপী ছাগীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে ফেললো। এতে মা কালী দারুণ ক্রুদ্ধ হলেন। তখনই তিনি প্রতিদিন তাঁর সামনে পাঁঠাকে বলি দেওয়ার কথা বলেন। এভাবেই কালী পুজোয় পাঁঠাবলীর নিয়ম হয়েছে বলে কালিকাপুরান থেকে জানা গেছে। তবে এর সত্যতা এই লেখিকা বা নিউজ স্টারডম.ইন যাচাই করতে পারে নি। সবটাই কথিত আছে।

হিন্দুধর্মে বহুক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে শাক্ত ও বৈষ্ণব উৎসব মিলেমিশে যায়। শক্তি আরাধনার অন্যতম উৎসব হল কালীপুজো। তার ঠিক পরেই বৈষ্ণবদের গুরুত্বপূর্ণ গোবর্ধন উৎসব এবং অন্নকূট। বহু জায়গাতে দুটি উৎসব একসঙ্গেই পালিত হয়। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিনেই পালিত হয় গোবর্ধন উৎসব। ভাগবৎ পুরান অনুযায়ী এদিন শ্রীকৃষ্ণ নিজের কনিষ্ঠ আঙুলে গোবর্ধন পর্বতকে তুলে ধরেছিলেন প্রবল বৃষ্টি থেকে বৃন্দাবন শহরকে রক্ষা করতে। এভাবেই বিশ্ব ধরিত্রীকে রক্ষা করেন বিধাতা। তাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অন্নকূট উৎসর্গ করা হয়।

অন্ন মানে ভাত আর কূট মানে পাহাড়। ভাতের পাহাড়ের সঙ্গে বিভিন্ন নিরামিষ পদ দিয়ে ভোগপ্রসাদ সাজিয়ে গোবর্ধন পাহাড়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে এই উৎসব পালিত হয়। ভারতের অনেক মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেব বিগ্রহের সামনেও অন্নকূট উৎসর্গ করা হয়। প্রতি বছর কালীপুজোর পরের দিনই অন্নকূট উৎসব হয়। তবে এবছর কালী পুজোর পরের দিন সূর্য গ্রহণ পড়ায় অন্নকূট উৎসব পালিত হবে বুধবার।

আজ কার্তিক মাসের অমাবস্যা, তাই সকাল থেকেই  মা কালীর পুজোর আয়োজন শুরু হয়েছে , যদিও এই পুজো একটু রাতের দিকেই অনুষ্ঠিত হয়। তবুও সারাদিন ধরেই চলে প্রস্তুতি পর্ব , যাতে কোন ত্রুটি না থেকে যায়। মা কালী অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করেন। তাই মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা, সমস্ত অশুভ নাশ করে সবার মধ্যে যেন শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।

More from CultureMore posts in Culture »
More from SocialMore posts in Social »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.