Press "Enter" to skip to content

আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের বই বিক্রেতারা জানতেন বিপদে-আপদে কাছের মানুষ হিসেবে। কোনও বই- ফেরিওয়ালা অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি….।

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

বাবলু ভট্টাচার্য : বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন সারা জীবনে একবারও বিদেশে না যাওয়ার কারণ হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়কে ‘পশ্চিমের জানলা’ রূপে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। আসলে সুনীতিকুমারের মেধার মহাসাগর অতলান্ত, পাণ্ডিত্যের পর্বত গগনচুম্বী।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুকুমার সেন তাই বলেন, ‘উচ্চতা অনেক রকমের হয়। হিমালয়ও উচ্চ, আবার মহীরূহও উচ্চ। একটি নিষ্প্রাণ, অন্যটি জীবনরসে সমৃদ্ধ। সুনীতিবাবুর ছিল সেই বনস্পতির উচ্চতা।’

১৮৯০ থেকে ১৯৭৭— এই ৮৭ বছরের জীবনে, জাতীয় অধ্যাপকের উচ্চতা বা বিশ্বখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানীর গাম্ভীর্য সরিয়ে বার বার বেরিয়ে এসেছে তার সহজ-সরল সত্তাটি। এক বার গ্রাম থেকে এক ভদ্রলোক তার বাড়িতে এসেছেন। কিন্তু সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। সংকোচের সঙ্গে বলছেন, ‘স্যার, খালি পায়ে এসেছি। পায়ে ধুলো ভর্তি।’ সুনীতিকুমার হেসে বললেন, ‘আমরা বাঙালি। আমরা বহু দিন থেকে শুধু বলে আসছি, বাড়িতে পায়ের ধুলো দেবেন। ফলে কুণ্ঠিত হবেন না। ভেতরে চলুন।’

কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের বই বিক্রেতারা তাকে জানতেন বিপদে-আপদে কাছের মানুষ হিসেবে। কোনও বই- ফেরিওয়ালা অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করতেন তিনি। কংগ্রেস মন্ত্রিসভা এক সময় ফুটপাতে বই বিক্রি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। বিরোধিতা করে সুনীতিবাবু প্রতিবাদপত্র পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রীকে। বন্ধ হল সেই চেষ্টা।

নিজের সময়ে নিজের দেশের পয়লা নম্বর ভাষাবিজ্ঞানী। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্ত থেকে আমন্ত্রণ। গবেষণা, বক্তৃতা, খ্যাতি, পুরস্কার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘ভাষাচার্য’, উপন্যাসের নায়কের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন ‘সুনীতি চাটুজ্যের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব’। কিন্তু এ হেন সুনীতিকুমার সারাটা জীবন শুধু ভাষাবিজ্ঞানী হয়ে থাকলেন না। এ নিয়ে অনেকেরই অভিযোগের অন্ত নেই। তাঁরা ভাষাবিজ্ঞান কতটা বোঝেন জানা নেই, কিন্তু সুনীতিকুমারকে বোঝেননি। ভাষাকে আশ্রয় করে তিনি পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন মানুষের সংস্কৃতি তথা জীবনের বিস্তৃত চৌহদ্দিতে।

১৯২৭-এ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা, থাইল্যান্ড, মালয়, বালি ভ্রমণের আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা তো আমরা পেয়েছি তাঁর ‘রবীন্দ্র-সংগমে দ্বীপময় ভারত ও শ্যামদেশ’ নামক বইটিতে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘জাভাযাত্রীর পত্র’-এ জানাচ্ছেন- ‘আমাদের দলের মধ্যে আছেন সুনীতি। আমি তাঁকে নিছক পণ্ডিত বলেই জানতুম। অর্থাৎ, আস্ত জিনিসকে টুকরো করা ও টুকরো জিনিসকে জোড়া দেওয়ার কাজেই তিনি হাত পাকিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস ছিল।

কিন্তু এবার দেখলুম, বিশ্ব বলতে যে ছবির স্রোতকে বোঝায়, যা ভিড় করে ছোটে এবং এক মুহূর্ত স্থির থাকে না, তাকে তিনি তালভঙ্গ না করে মনের মধ্যে দ্রুত এবং সম্পূর্ণ ধরতে পারেন আর কাগজে-কলমে সেটা দ্রুত এবং সম্পূর্ণ তুলে নিতে পারেন। এই শক্তির মূলে আছে বিশ্ব-ব্যাপারের প্রতি তাঁর মনের সজীব আগ্রহ।’

তাঁর প্রতিভার প্রশংসা করলে তিনি অবলীলায় বলতেন, ইউরোপের যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর ঝাঁট দিলে নাকি দশ-বিশটা সুনীতি চাটুজ্যে পাওয়া যাবে। আবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বই কাউকে দেখাতে হলে তাঁকে উৎসর্গ করা বইগুলো লুকিয়ে রাখতেন, পাছে সেটা আত্মপ্রচার হয়ে দাঁড়ায়।

কোনও মানুষের, এমনকী ছাত্র-ছাত্রীদেরও প্রণাম নিতেন না, উলটে তাদের ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোনও অজানা বিষয় জানলে অন্য অধ্যাপকদের সামনেই সেই স্বীকৃতি দিতেন। ছাত্রী হিসেবে সুকুমারী ভট্টাচার্য তো এর জন্য লজ্জিত বোধ করার কথাই স্বীকার করেছেন।

বার বার বলতেন রবীন্দ্রনাথের কথা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে শুধু প্রিয় কবি নন, ছিলেন আদর্শ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের নায়ক অমিত সুনীতিবাবুর বই নিয়ে শিলং-এ গিয়েছিল। সুনীতিবাবু মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ যেন এ ভাবেই তাঁকে অমরত্ব দিয়ে গেলেন। তাঁর নিজের সমস্ত কীর্তি ম্লান হয়ে গেলেও বাঙালি যেন শুধু এই রাবীন্দ্রিক রেফারেন্সের জন্যই তাঁকে ভুলতে পারবে না।

সুনীতিকুমার সত্যসন্ধানী। ভাষার উৎস সন্ধানে অযৌক্তিক ঘৃণা বা জবরদস্তি পক্ষপাত তাঁর ছিল না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ উৎসর্গ করেছিলেন এই সুনীতিকুমারকেই।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৮৯০ সালের আজকের দিনে (২৬ নভেম্বর) হাওড়ার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.