জন্মদিনে স্মরণঃ অ জি তে শ ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : ছ’ফুটের উপর লম্বা। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য রকমের চাহনি। প্রাণখোলা হাসি। দাপিয়ে অভিনয় করছেন মঞ্চে। গান গাইছেন। নাচছেন। প্রযোজনা নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন কলকাতা থেকে সারা বাংলা। বাংলার বাইরে। নেপথ্যে চলছে নাটক লেখা। নাটক নির্মাণ। নির্দেশনা। সংগঠন সামলানো। স্কুলে পড়ানো।
তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভুবনমোহন ও লক্ষ্মীরানির বড় ছেলে অজিতেশ। তাঁর বাবা আসানসোল শিল্পাঞ্চলের রামনগর কোলিয়ারিতে কাজ করেন। একটু বড় হতেই অজিত দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেটা ১৯৪২, তখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর। জাপানি বোমার ভয়ে ভুবনমোহন তাঁকে পুরুলিয়ার ঝালদায় এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
ইংরেজির স্নাতক অজিতেশ শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিলেন কলকাতার বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে। পার্টি কর্মী, তথা গণনাট্য সঙ্ঘ পাতিপুকুর শাখার শিল্পী অজিতকে তখন সবাই এক ডাকে চেনে।
দমদম আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর অজিতেশ এর উপর দায়িত্ব পড়ে গণনাট্য সঙ্ঘের চারটি শাখাকে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা তৈরি করার। মঞ্চস্থ হয় ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’। তার পর ধারাবাহিক ভাবে সঙ্ঘের কাজ করেছেন তিনি, মূলত থিয়েটারকে আঁকড়ে।
তাই গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে সরে এসে ১৯৬০-এর ২৯ জুন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় স্বতন্ত্র সত্তায় আত্মপ্রকাশ করল আজকের ‘নান্দীকার’। এর পর প্রায় ১৭ বছর এই সংগঠনের সঙ্গে থিয়েটারকে নিয়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলেন অজিতেশ।
তাঁর নির্দেশনায় একের পর এক মঞ্চসফল প্রযোজনা করেছে নান্দীকার। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘যখন একা’, ‘নানা রঙের দিন’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘শের আফগান’, ‘ভাল মানুষ’— তালিকায় নাম বাড়তেই থাকে।
নির্দেশনার পাশাপাশি নাটকের গান তৈরি করা, সে গানের সুর দেওয়া, বিদেশি নাটকের আত্তীকরণ, মৌলিক নাটক লেখা— সবই চলতে থাকে অজিতেশের।
১৯৭৭-এ ‘সাংগঠনিক কারণ’-এ নিজেরই তৈরি করা দল ‘নান্দীকার’ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অজিতেশ। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি গঠন করলেন নতুন সংস্থা, ‘নান্দীমুখ’।
ষাটের দশক থেকে তিনি সিনেমাতেও অভিনয় করা শুরু করেন। সব মিলিয়ে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এর মধ্যে কয়েকটি হিন্দি ছবিও আছে। তপন সিংহ, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্ত, অরুন্ধতী দেবী, মৃণাল সেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তরুণ মজুমদার ছাড়াও আরও অনেক পরিচালকের নির্দেশনায় তিনি সিনেমায় অভিনয় করেন।
যাত্রার ক্ষেত্রেও একই রকম সফল অজিতেশ। এবং জনপ্রিয়। গ্রামবাংলার মানুষ যাত্রাশিল্পী অজিতেশের অভিনয়ে বুঁদ হয়ে ছিল। থিয়েটারের বৃত্তের বাইরে একটা বড় সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছতেই অজিতেশের যাত্রায় যোগ দেওয়া।
১৯৮৩ সালের ১৩ অক্টোবর মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৩ সালের আজকের দিনে (৩০ সেপ্টেম্বর) পুরুলিয়ার রোপো গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment