ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ১৮ জুলাই, ২০২৫। “শ্রাবণ” শব্দটি এসেছে “শ্রবণ” থেকে ৷ তাই এই সময় কাল শুভ কথা শোনার মাস ৷ এ মাসের সোমবারের ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে মহাদেবের ধ্যান করে “ওঁ নমঃ শিবায় ” মন্ত্র বা শিব স্তোত্র পাঠ করে শিব , পার্বতী ও নন্দীকে দুধ গঙ্গাজল নিবেদন করার প্রথা সুপ্রাচীন ৷ এতে সমস্ত অশুভ শক্তি দূর হয় ৷ মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠে মনে শান্তি আসে ও সব বিপদমুক্ত হওয়া যায় ৷ এ মাসেই পিতা দক্ষের মুখে পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী প্রাণ ত্যাগ করেন ৷ পরের জন্মে হিমালয় কন্যা পার্বতী শিবকে তুষ্ট করেন এবং দু জনের মিলন হয় ৷ শ্রাবণ মাসে বাবা ভোলানাথ মর্ত্যে শ্বশুরবাড়ীতে আসেন বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ৷ শিব -পার্বতীর মিলনের এ মাস তাই শিবের মাস শুধু নয় হিন্দুদের সবচেয়ে পবিত্র মাস ৷এই মাসেই শিব হন “যোগীন্দ্র ” ৷
এমাসের গুরু পূর্ণিমা তিথিতে মহাদেব সাত জন ঋষিকে শিষ্যত্ব দান করেছিলেন ৷ শ্রাবণ শিবের একটি নাম ৷ হিন্দুদের বিশ্বাস শিবের ডান চোখ সূর্য , বাঁ -চাঁদ আর মধ্য নেত্র অগ্নি ৷ চাঁদের কর্কট ও সূর্যের সিংহ রাশি ৷ সূর্য এই মাসে কর্কট থেকে সিংহ রাশির দিকে যায় ৷ তাই এ মাস শিবের সবচেয়ে প্রিয় বলে সনৎকুমারদের জানিয়েছিলেন ৷ সোম, শিবের আরেক নাম ৷ সোমবার চন্দ্রমার দিন ৷ চাঁদ শিবের চোখ এবং তাঁর অন্য এক নাম সোম ৷ চন্দ্রমা বা সোম ব্রাহ্মণদের রাজা এবং ঔষধির দেবতা ৷ তাই এদিন উপবাস করলে শারীরিক , মানসিক ও আর্থিক সমস্যা দূর হয় ৷ এ মাসের সোমবার ব্রত পালনে ১২ মাসের সব সোমবার পালনের ফল মেলে ৷ স্মৃতি ও ইচ্ছা শক্তি বাড়ে৷ সোমবারের ব্রত রোটক ৷ আমার লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” ও “হিন্দু ধর্ম “বই দুটিতে হিন্দু ধর্মের বহু বিষয় নিয়ে বিস্তারিত পড়তে পারেন ৷ এই শ্রাবণ মাসেই সমুদ্র মন্থন হয়েছিল ৷ উঠে আসে মহাগরল কালকূট ৷ শিব জগৎ সংসারকে রক্ষা করতে বিষ পান করেন ৷ তখন পার্বতী তাঁর গলা টিপে ধরেন যাতে বিষ গলার নিচে নামতে পারে না ৷ এতে গলা নীল রঙ ধারণ করে তাই শিব নীলকন্ঠ ৷ সেসময় তাঁর বিষের জ্বালা দূর করতে সব দেবদেবী মহাদেবের মাথায় গঙ্গার জল ঢালতে থাকেন ৷ মাতা ভগবতী পার্বতী তাঁর স্তনের দুধ পান করিয়ে দেবাদিদেবের জ্বালা নিবৃত্তি করেন ৷ সৃষ্টি রক্ষা পায় ৷ এজন্য এই সময় সর্বত্র কাঁধে করে জল নিয়ে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ভোলেবাবার মাথায় সেই জল ঢালেন ৷তাকে বলে জলাভিষেক ৷ তারকেশ্বরের তারকনাথের আর্বিভাব হয় এ মাসে ৷ বাবা তারকনাথ সিনেমার পর তারকনাথের ভক্ত সংখ্যা বাড়ে ৷মাথায় জল ঢালতে শেওড়াফুলির নিমাই তীর্থ ঘাট থেকে লাখো ভক্ত দীর্ঘপথ হেঁটে তারকনাথের মাথায় জল ঢালেন ৷ এমন ভাবে জল ঢালা হয় সব জায়গায় শিবের মন্দিরে ৷ কাঁবাড়িয়া বা কাঁধে জল নিয়ে কৃচ্ছসাধন করে জল ঢাললে ভোলে বাবা পার করেন বলে জ্যোতিষ শাস্ত্রে ও শৈব গ্রন্থে লেখা আছে ৷যেহেতু এ মাসে শিব কৈলাস ছেড়ে শ্বশুর বাড়ী ও মর্ত্যে ভক্তদের কাছে চলে আসেন ৷ তাই , তাঁকে ভক্তি ভরে পুজো করে এবং পঞ্চামৃত ( দুধ , দই , ঘি , মধু ও কুশদোক) দ্বারা অভিষেক করে দুধ- গঙ্গার জল ঢাললে তিনি অভিষ্ট সিদ্ধ করেন ৷ দানের জন্য কুশ তৃণ সহিত যে উদক বা জল দেওয়া হয় তাই “কুশদোক” ৷ ধুতরা , আকন্দ , অপরাজিতা এবং কল্কে ফুল ও বেলপাতা অর্পণ করা হয় ৷ “শিব” মানে মঙ্গল আর “শম্ভু” মানে কল্যাণ ৷ এই মাসের সোমবার গুলিতে উপবাস করে শিবের অভিষেক করলে তিনি মঙ্গল দান করেন ও কল্যাণ করেন ৷ সুখ -সমৃদ্ধি লাভ হয় ৷ অবিবাহিতরা পছন্দমত স্বামী বা স্ত্রী পায় ৷ শ্রাবণ মাসের সোমবার শুধু নয় এখন থেকে ১৬টি সোমবারের ব্রত পালন করেছিলেন শিবের ঘরণী পার্বতী ৷
” বিল্ব পত্র বা বেল পাতা “বেলপাতা তিনটিফলক যুক্ত একটি পাতা ।পুরাণ মতে বেল পাতার পেছনের অংশে মা লক্ষ্মীর বাস। বেল পাতা তিন গুন স্বত্ত্ব, তম, ও রজো গুণের এবং ত্রিদেব এর প্রতীক।শিবের মূর্তি ও শিব লিঙ্গের মাথায় বেলপাতা দিতে হয় ৷ চতুর্থী , অষ্টমী , নবমী, অমাবস্যা , সংক্রান্তি ও প্রতি সোমবার মহাদেবের মাথা থেকে বেলপাতা নামাতে নেই ৷ ১১টি বেলপাতা দিয়ে তৈরি মালা শিবলিঙ্গে অর্পণ করলে অশুভ প্রভাব জীবন থেকে দূরে সরে যায় ৷ বিল্বপুষ্প ( বেলের ফুল ৷ সুগন্ধী বেলি ফুল নয় ) শিব লিঙ্গে অর্পণ করলে সারা জীবন সাধনার ফল লাভ হয় ৷ ঐ ব্যক্তি মৃত্যুর পর শিবলোক প্রাপ্ত হয় ৷
“ধুতুরা ফুল ”
Dutura metel একটি বিষাক্ত গাছ ৷ শ্বাস কষ্ট , বাতের ব্যথা , টাক পড়া ও মেয়েলি রোগে ব্যবহৃত হয় ৷ এর বীজ থেকে চেতনা নাশক পদার্থ তৈরী হয় ৷ বিষক্রিয়ায় মানুষ ও পশুর জীবনহানি হানি হতে পারে ৷
ধুতুরা মহাদেব শিবের অত্যন্ত প্রিয় ফুল।বিভিন্ন পুরাণ অনুযায়ী শিবলিঙ্গ ধুতুরা ফুল দিয়ে পূজা করলে জীবনে সমৃদ্ধি আসে। এর ফলে জীবন অনেক সহজ হয় ৷ এক বছর একাদশী পালনের ফল মেলে একটি ধুতরা ফুল শিবলিঙ্গে অর্পণ করলে ।ভগবান শিব থাকেন কৈলাশ পর্বতে। এই ঠান্ডা এলাকায় এমন ধরনের আহার ও ওষুধের প্রয়োজন হয় যা শরীরকে উষ্ণতা দেবে। ধুতুরা হলো সেই রকমই ওষুধ।
“আকন্দ ফুল”
calotropis gigantea গাছটিও বিষাক্ত ৷তবে, আমরা চিকিৎসকরা বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস , শোথ , অর্শ , ক্রিমি , প্লীহা ও শ্বাসকষ্ট রোগে ব্যবহার করি ৷
আকন্দ ফুলের পাঁচটি খণ্ড থাকে যা শিবের পঞ্চানন রূপকে নির্দেশ করে। আকন্দের রং সাদা।সাদা রং সরলতার ,সহজতার প্রতীক।শিব আশুতোষ এবং তিনিও সহজ এবং সরল।তাই আকন্দ ফুল শিবের অত্যন্ত প্রিয়।পুরাণ অনুযায়ী শিব পূজোয় একটি আকন্দ ফুল অর্পণ করার অর্থ হলো সোনা দান করার সমান ।
“দুধ -গঙ্গাজল ”
শিবলিঙ্গে দুধ প্রদান করার জন্য জন্য তামার পাত্রই ব্যবহার করা উচিত।শিব পূজার সময় অবশ্যই দেওয়া হয় দুধ ও গঙ্গাজল। শিবলিঙ্গে দুধ-গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানোর বিধি অতি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। বিশ্বাস করা হয় যে, এর ফলে জীবন সুখের হয়।
“জাফরান ”
Saefron বা জাফরান ক্রোকাস একরকম দামী মশলা ৷ তাই সবার জাফরান দিয়ে শিব পূজা করার সামর্থ্য থাকে না।তবুও বিবাহিত জীবনে সুখী হতে শিবলিঙ্গে জাফরান অর্পণ করার বিধি আছে।
“তিল”
sesamum indicum একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ ৷ আমাশয় , দাঁত , মাড়ির রোগ , ফোড়া ও পচা ক্ষতে উপকারী ৷
জ্যোতিষ মতে শিবলিঙ্গে তিল প্রদান করে অনেকেই শনির সাড়ে সাতি দশা কাটায়। এটি একটি পুরানো রীতি ৷
” দূর্বা ঘাস”
ঘাস জাতীয় এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Cynodon dactylon . এই ওষুধি গাছ রক্ত বন্ধ করে ৷ পায়োরিয়া, চুল পড়া রোগে ব্যবহার হয় ৷
শিবলিঙ্গে দুর্বাঘাস প্রদান করলে নীরোগ জীবন লাভ হয় বলে সনাতন ধর্মে মনে করা হয় । তাই সকলেই শিবলিঙ্গ পূজায় দূর্বা ঘাস ব্যবহার করে।
“আতপ চাল”
ধান রোদে দিয়ে হয় আতপ চাল ৷ এতে চালের প্রায় সব পুষ্টি গুণ বিদ্যমান থাকে ৷শিবকে আতপ চাল অর্পণ করলে আর্থিক সমস্যা মেটে ।আর্থিক সমৃদ্ধিকে অব্যাহত রাখতে শিবলিঙ্গে চাল প্রদান করাও প্রাচীন রীতি।
“কর্পূর”
কর্পূরের সুগন্ধ ভগবান শিবের সবথেকে প্রিয়। এই গন্ধ পরিবেশকে পবিত্র ও শুদ্ধ করে। কর্পূর দিয়ে পূজো করলে ভগবান শিব প্রসন্ন হন।
” শ্বেত চন্দন ”
শ্বেত চন্দন শীতল প্রকৃতির ৷ শিবলিঙ্গে শ্বেত চন্দন লাগালে জীবনে সুখ – শান্তি আসে ৷
“গম”
গম অর্পণ করলে দ্রুত সন্তান ধারণের স্বপ্ন পূরণ হয় ৷
“রুদ্রাক্ষ ধারণ”
রুদ্রাক্ষ দেবাদিদেবের খুব প্রিয় ৷ অন্য মাসের চেয়ে এ মাসে রুদ্রাক্ষ ধারণ বেশী ফলদায়ী ৷
অজানা তথ্য সমৃদ্ধ – শ্রাবণ মাস শিব ঠাকুরের মাস….।

More from CultureMore posts in Culture »
- ‘যুগলবন্দী একাডেমি’র চতুর্থ বর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান….।
- স্বামী প্রনবানন্দ মহারাজের আবির্ভাব বর্ষে ১৩০ নদীর পবিত্র জল দিয়ে মহাভিষেক,আনন্দে ভাসল এলাকা….।
- NCSM Wins Prestigious CIMUSET Award for Science City Kolkata’s “On The Edge?” Climate Change Gallery….
- Magic, smiles and health tips light up Children’s Day celebration at Manipal Mukundapur…
- কলকাতায় ইন্ডাস্ট্রি-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ ও অতনু ঘোষের বিশেষ অভিনয় কর্মশালার মাধ্যমে বি আই এ-র স্কুল অফ পারফর্মিং আর্টস এর উদ্বোধন…।
- গোবরডাঙা শিল্পায়ন স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল জনপ্রিয় নাটক রবীন্দ্র জয়ন্তী….।
More from GeneralMore posts in General »
- বিধাননগরের বিভিন্ন প্রান্তের নাগরিকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হল সিটিজেনস মিট….।
- Decarbonizing Steel: Pathways to a Low-Carbon Future….
- তথ্য বিকৃতির বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয় আলোচনা সভা…।
- TV9 বাংলার নতুন নিউজ সিরিজ ‘ব্যাটলফিল্ড বিহার’….।
- The Institute of Chartered Accountants of India (ICAI) hosts MSME Connect: ‘Stakeholders Strategic Meet 2025 and launches the ‘MSME Clinic Initiative’…..
- TV9 বাংলার নিউজ সিরিজে ‘বাংলায় SIR’….।
More from InternationalMore posts in International »
- ‘যুগলবন্দী একাডেমি’র চতুর্থ বর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান….।
- স্বামী প্রনবানন্দ মহারাজের আবির্ভাব বর্ষে ১৩০ নদীর পবিত্র জল দিয়ে মহাভিষেক,আনন্দে ভাসল এলাকা….।
- নারায়ণা হেলথ, বেঙ্গালুরু কর্তৃক কলকাতায় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য পূর্ব ভারতের অন্যতম বৃহত্তম এইচএলএ টেস্টিং ক্যাম্পের আয়োজন….।
- বিধাননগরের বিভিন্ন প্রান্তের নাগরিকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হল সিটিজেনস মিট….।
- চলছে এখন এস,আই,আর(SIR)…।
- যুবভারতীতে বেটন কাপে চ্যাম্পিয়ন সেনা দল….।















Be First to Comment