” ভালোবাসা দিবস ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভালোবাসা “(HAPPY VALENTINE DAY &
MEDICAL FACTS ABOUT LOVE )!
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। ভালোবাসা এমন একটি প্ল্যাটর্ফম যেখানে সব মানুষকে একসাথে দাঁড় করানো যায় ” আবার
” ভালোবাসা ও যত্নে মরুভূমিতেও ফুল ফোটে ” !
তাই , যখন মানুষে মানুষে , জাতিতে জাতিতে ,ধর্মে ধর্মে এত বিভেদ মারামারি তখন ভালোবাসার দাবীই সর্বাধিক ৷ ” বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ” বা ভ্যালেন্টাইন দিবসে ১৪ ফেব্রুয়ারি এসো সবাই একসাথে পৃথিবীকে বিদ্বেষ থেকে মুক্ত করে বিশ্বাস ও ভালোবাসায় বেঁধে সুন্দর করে তুলি খ্রিস্টানদের অনেক দিবস আছে সেন্ট প্যাট্রিকস ডে , সেন্ট মার্টিন্স ডে ৷ সেরকমই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে যা ভালোবাসার মার্ধুযে পাশ্চাত্য পেরিয়ে আমাদের মত দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে ৷ রোমে তখন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার অপরাধ হিসাবে গণ্য হতো ৷ সেই ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও চিকিৎসক ছিলেন যিনি জেলার আস্টোরিয়াসের অন্ধ মেয়েকে সারিয়ে তোলেন ৷
এতে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠলে রোম সম্রাট ক্লডিয়াস ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেন ৷ মৃত্যুর আগে জেলারের মাধ্যমেই ঐ মেয়েটিকে তিনি শেষ চিঠিটি লেখেন ” ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন ” বলে ৷ সেই দিনটি ছিল আজকের মত ১৪ ফেব্রুয়ারি ৷
৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ প্রথম জেলাসিয়াস ভ্যালেন্টাইনের স্মরণে ফ্রেন্ড অব লার্ভাসের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে ” ভ্যালেন্টাইন ডে ” বলে ঘোষনা করেন ৷ সেই থেকে “ভালোবাসা দিবস”
বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ৷ বিশেষতঃ প্রেমিক -প্রেমিকাদের মধ্যে ৷ তবে ভালোবাসার সংজ্ঞা শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় , স্বামী -স্ত্রী , ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, বন্ধু – বান্ধবী নয় ছড়িয়ে দেওয়া উচিত সব মানুষের মধ্যে ৷ কারন , আমি মনে করি মানবিকতার আরেক নাম ” ভালোবাসা ” ৷ তা সফল হতে পারে পৃথিবী ভালোবাসায় ভরে গেলে ৷ বিশেষ কারো জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হলো ভালোবাসা ৷ আবেগধর্মী ভালোবাসা খুব গভীর হয় ৷ তখন তার সঙ্গে নিজের সমস্ত মানবিক অনুভূতি এমনকি শরীরও ভাগ করে নেওয়া যায় ৷শুধু প্রেমিক -প্রেমিকার মধ্যে নয় আত্মীয়দের মধ্যে , পোষ্য প্রাণী বা বস্তুর বা কাজের কিংবা খাবারের প্রতি আনন্দদায়ক অনুভূতিও ভালোবাসা ৷ নিষ্কাম প্রেম বা ধর্ম প্রীতিও ভালোবাসা হতে পারে ৷এই দিন প্রেমিক
প্রেমিকারা একে অন্যকে বলে ,”আমি তোমাকে চাই কল্পনাতে নয় বাস্তবে ৷ তোমাকে চাই ছলনায় নয় শুধু ভালোবাসায় ৷ আমার মত করে ৷ক্ষণিকের জন্য নয় চিরদিনের জন্য “৷ তাই , ” ভালোবাসা ” বা “প্রেম” , পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র অনুভূতি ৷
সর্বাধিক চর্চিত ও দোলা দেওয়া বিষয় ৷ আদম -ইভের আমল থেকে বা কামদেবের ইচ্ছায় মানুষের মধ্যে এবং প্রাণীকুলের সৃষ্ঠি থেকে প্রতিটি জীবের মধ্যে চলে আসছে ৷এর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে সৃষ্টি ৷ বিশ্বের সব ভাষায় এ পর্যন্ত যত গান , কবিতা , গল্প , উপন্যাস ,
নাটক থেকে সিনেমা হয়েছে বেশীর ভাগই প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে ৷ তাই , ভুলেও ভাববেন না আমি এখানে আবার তার চর্বিত চর্বন করতে বসেছি ৷
আমি পেশাদার চিকিৎসক ও একজন মনোবিদ হিসাবে এই আলোচনা করছি শুধু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে ৷ বিজ্ঞানের সাধারণ পড়াশুনা থাকা ছেলেমেয়েরাও জানে জীবের সবকিছুর মাঝেই বিভিন্ন হরমোন ও রাসায়নিকের খেলা ৷
প্রেম ও ভালোবাসা হলো মস্তিষ্কের থ্যালামাসের এই রকমই এক রাসায়নিক অবস্থা ৷নিউরোট্রান্সমিটার , ডোপামিন , সেরেটোনিন , নরেপিনেফ্রিন হরমোনের কাজের ফল ৷ এসব বুঝতে এখন অনেক রাসায়নিক বিশ্লেষণ ও যন্ত্রপাতি কাজে লাগানো হয়েছে ৷ যেমন কোন প্রেমিক বা প্রেমিকার সামনে তার ভালোবাসার মানুষের ছবি দেখিয়ে মস্তিষ্কের ফাংশনাল এম আর আই ( FMRI) করে দেখা গেছে তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল ও কডেট অংশ উদ্দীপিত হচ্ছে এবং প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নিঃসৃত হচ্ছে ৷ আরো দেখা যায় অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন হরমোনের কারিকুরি ! শুধু প্রেমে পড়াই নয় তাকে টিকিয়ে রাখতেও মূল ভূমিকা হরমোনের ৷ এই দুই হরমোন আসে হাইপোথ্যালামাস থেকে ৷গ্রাহক অর্থাৎ রিসেপ্টর জিনে ভেসোপ্রেসিন হরমোন বেশী থাকলে তা পুরুষের একগামী মনোবৃত্তিকে বোঝায় ৷বিজ্ঞানীরা ভেসোপ্রেসিনের প্রবাহ রোধ করে একগামী (একজন সঙ্গিনী যার) ইঁদুরকে বহুগামী এবং বেশী মাত্রায় ভেসোপ্রেসিন দিয়ে বহুগামী ইঁদুরকে একগামী করতে সর্মথ হয়েছেন ৷অক্সিটোসিন হরমোনকে বলে Love Hormone .
প্রেমিক /প্রেমিকা বা প্রিয়জন (ভালোলাগার যেকেউ) কাছাকাছি এলে এই হরমোন শরীরে উৎপন্ন হয় ৷হার্ট বা হৃদয় থেকে একরকম তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্র Electo magnetic field নিঃসৃত হয় ৷কতটা হবে তা নির্ভর করে আবেগের ধরনের উপর ৷কখনো কখনো প্রাণীর শরীরের চারদিকে কয়েক ফুট পর্যন্ত তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্রের রেশ পাওয়া যায় ৷ এজন্য হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায় ৷ অনেকের হাতের তালু ঘেমে যায় ৷প্রেমে পড়ার শুরুতে উভয়ের মধ্যে যে লালসা সৃষ্টি হয় ৷ এর জন্য দায়ী মেয়েদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন ও ছেলেদের টেস্টোটেরন হরমোন ৷মনোবিজ্ঞান বলে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হতে পাঁচ মিনিট সময়ই যথেষ্ট ৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে আকর্ষণ এসে গেলে মানুষ পছন্দের মানুষটি ছাড়া কোন কিছু ভাবতে পারে না ৷ খাওয়া , ঘুমানো থেকে কাজে ভুল হয় ৷ তখন ক্রিয়া করে মনোয়ামাইন স্নায়ুগুচ্ছ ৷ এগুলি হলো ডোপামিন ও এড্রিনালিন ৷প্রেমে পড়া মানুষটার বিচারবুদ্ধি কমে যায় ৷মানুষ হয় নির্ভার ও নির্ভয় ৷ যার প্রমাণ রোমিও -জুলিয়েট কিংবা লায়লা -মজনু ৷যৌন আকর্ষণ Sexual attraction এবং যত্ন Attachment -র আবেগজনিত বন্ধন গড়ে ওঠে রোমান্টিক ভালোবাসায় ৷শরীরে ডোপামিন দেয় পরমানন্দের অনুভূতি ৷ যেন সে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে ৷ এর সঙ্গে যোগ হয় সেরোটোনিন ৷ এরপর আসে স্থায়িত্বের আকাঙ্খা ৷ দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বা বিয়ের দিকে এগোয় ৷ডোপামিনের সঙ্গে শরীরে উৎপাদিত হয় নার্ভ গ্রোথ ফ্যাক্টর ৷যারা প্রেমের সম্বন্ধকে দীর্ঘমেয়াদী করতে আগ্রহী তাদের নার্ভ গ্রোথ ফ্যাক্টর বেশী থাকে ৷প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে চেহারা ও গন্ধের ভূমিকাও যথেষ্ট ৷দেখা গেছে নিজের অজান্তে মানুষ বাবা -মা বা প্রিয় জনের মত চেহারা ও গন্ধ খোঁজে ! প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে ৫৫% বাহ্যিক রূপ ও অঙ্গভঙ্গি , ৩৮% কন্ঠস্বর বা বাচন ভঙ্গি এবং সাত শতাংশ মূল বক্তব্য শোনে ৷অক্সিটোসিন হরমোনের ফলে আমরা আনন্দ ও রিল্যাক্স অনুভব করি ৷তৈরী হয় পুরস্কার ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির অনুভূতি এবং আবেগ জনিত নির্ভরশীলতা ৷ প্রেম হলো দুই স্নায়ু তন্ত্র( Nervous System) এর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ৷ভালোবাসার তিন পর্যায় কামনা , ভালোলাগা ও আনুগত্য ৷অক্সিটোসিন ও ভ্যাসোপ্রেসিন হরমোন অধিক নিঃসৃত হওয়ায় মস্তিষ্কে নিরাপত্তা ও স্থিতির অনুভূতি তৈরী হয় ৷
এরফলে ঐ সঙ্গীর সঙ্গেই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করতে চায় ৷ কামনায় এড্রেনালিন ও নরপিনেফ্রিন হরমোন বেশী পরিমানে বের হয় ৷ তাই , হৃপিন্ডের গতি বৃদ্ধি পায় ও হাতের তালু ঘামতে থাকে ৷ ডোপামিনও বেড়ে গিয়ে ড্রাগ নেওয়ার মত উচ্ছ্বাসের অনুভূতি হয় ৷মরফিন যেমন ব্যথা কমায় প্রেমে পড়লে এজন্য শরীরে তাই ব্যথার অনুভূতি থাকে না ৷একে অপরকে আলিঙ্গন বা হাগ করলে শুধু মনের নয় দেহের ব্যথাও কমে যায় ৷মাথার সুখ কেন্দ্র বা প্লেজার সেন্টারে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যায় যদি দুজনে একত্র হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ৷ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের মত প্রেমাসক্ত পুরুষ / মহিলা একগুঁয়ে হয়ে পড়ে ৷
ঐ রোগে যেমন সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রা কমে যায় তেমনি হয় প্রেমে পড়লে ৷ একে অন্যের মাঝে কোন খুঁত দেখতে পায় না ৷ সঙ্গী/সঙ্গীনীর সব কাজই খুব পছন্দ হয় !যারা সঙ্গী / সঙ্গীনী পায় তাদের মন সবসময় আনন্দময় থাকে এবং নিজেরা ঠান্ডা থাকে ৷ফেরমোন এমন এক হরমোন যা বিপরীত লিঙ্গের মানুষ /প্রাণীকে আকর্ষণ করতে ভূমিকা গ্রহণ করে ৷ভালোবাসা এমন এক যাদু এর ছোঁয়ায় বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন এমনকি হার্ট এটাক হতে পারে না ৷বিভিন্ন রকম হরমোন ও মনোবৈজ্ঞানিক ইনটারএকশনে ভালোবাসা হয়ে উঠেছে একটি বিস্ময়কর বস্তু ৷ তবে , ভালোবাসার সব কিছুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনও দেওয়া যায় নি ৷ যেমন যদি কেউ তার সঙ্গীর সাথে মাত্র চার মিনিট একটানা চোখে চোখ লাগিয়ে থাকে তবে দেখা গেছে দুজনের হৃস্পন্দন একই গতিতে চলছে ! হয়তো , ভবিষ্যতে জানা যাবে এর বা ভালোবাসা সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের আরো অনেক কারণ ৷
সে পর্যন্ত এখন থাক ৷ বারান্তরে আরো আলোচনা করবো ৷ লেখাটি থেকে আমার রোগীদের বা বন্ধুদের কারো উপকার হলে চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে সার্থক মনে করবো ৷
সবাইকে জানাই “ভালোবাসা দিবসের “অভিনন্দন ৷
ছবি – সংগৃহিত ও গুগুল।
Be First to Comment