———————উত্তম বন্দনা———————-
প্রবীর রায় : বিশিষ্ট অভিনেতা, প্রযোজক ও চিত্র পরিচালক। ৩, সেপ্টেম্বর, ২০২০। আবার বছর ঘুরে এলো ৩রা সেপ্টেম্বর। আবার বাঙ্গালীর উত্তম বন্দনার দিন। ১৯৮০-র পর থেকে একটু একটু করে উত্তমকুমার “Larger than life” এক ব্যক্তিত্বে পর্যবসিত হয়েছেন। প্রতি বছরই ২৪শে জুলাই আর ৩রা সেপ্টেম্বর- এই দুটো দিন বাঙ্গালীর কাছে বাৎসরিক উৎসবের মতো। এখানে-সেখানে নানা অনুষ্ঠান, পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে নানা রকম লেখা, এখনও অসংখ্য মানুষের তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় অগণিত পোস্ট। প্রায় বছরেই এখনও তাঁকে নিয়ে দু-একখানা বই প্রকাশিত হয়েই চলেছে। এক কথায় এই প্রচার-সর্বস্ব সময়ে দাঁড়িয়ে উত্তমকুমার একটা ফেনোমেনন।
আমি ভাবি অন্য কথা। আমরা, যাঁরা সেই কিংবদন্তী শিল্পীকে দিনের পর দিন দেখেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, আড্ডা দিয়েছি কতো দিন, কতো রাত- সেই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের সান্ন্যিধ্য-ধন্য হয়ে বুঝেছি- নিজের ভেতরে একটা অসম্ভব আবেগ, সৃষ্টির তাড়না, খানিকটা প্রচার-বিমুখতা- এবং সর্বোপরি অসম্ভব ভালো মনের মানুষ না হলে বোধহয় একজন #উত্তমকুমার হওয়া যায় না। এই রকম একজন মানুষকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় ভরিয়ে দিতে আমাদের এতো কার্পণ্য কেন? ৪০ বছরেও তাঁকে নিয়ে একটা ইতিহাস- নির্ভর ডকুমেন্টারী কেন তৈরি হলো না? অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক… সব শৈল্পিক সত্ত্বাকে নিয়ে কোথাও পূর্ণাঙ্গ ভাবে তাঁকে বিশ্লেষণ করা হয়নি কেন? চূড়ান্ত অপমান, লাঞ্ছনা সয়ে একদিন তিনি পৌঁছেছিলেন আলোকজ্জ্বল শিখরে। সেই জেদ, অধ্যাবসায় আর হার-না-মানা মানসিকতাকে কে মনে রেখেছেন? আর্ক লাইট অতিক্রম করে তিনি ছিলেন একজন দায়িত্ববান সামাজিক মানুষ, দুঃস্থ কলাকুশলীদের সত্যিকারের সহমর্মী। সে কথাই বা আজ ক’জন মনে রেখেছেন?
দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্যার্থে উত্তমকুমার “শিল্পী সংসদ তৈরি করেছিলেন। সে ইতিহাসও অনেকের জানা। উত্তম-প্রয়ানের পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা মহানায়কের শিল্প-কীর্তিগুলি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোনও সৃষ্টিশীল পদক্ষেপ নিতে পারেনি। প্রতি বছর জুলাই মাসে ধরা-বাঁধা ক’খানা ছবি দেখিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। বরং আগে দূরদর্শনে অনেক পুরোনো ছবি দেখা যেত, যেগুলো কালের নিয়মে “হারিয়ে গেছে।“ হারিয়ে যায় কি করে? এতো বড় একটা সংস্থার নিজস্ব ওয়েবসাইট নেই কেন? কেন আরো বেশী মানুষের কাছে সংস্থার কর্মসূচী পৌঁছে দেওয়া যায় নি? এতো বছরে রাজ্য সরকারও কখনও এদিকে আলোকপাত করে নি। উত্তমকুমারের জন্মদিনে কেক আর পায়েসের থেকে অনেক বেশী প্রয়োজন ছিল এসব কর্মসূচির। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ২৪শে জুলাই আর ৩রা সেপ্টেম্বর যাঁরা ভিড় জমান মঞ্চে, টিভির সামনে, তাঁরা উত্তমকুমারের কটা ছবি দেখেছেন ওই কটা বাঁধা-ধরা সিনেমার বাইরে? আমরা আড়ম্বর করতেই ভালোবাসি। যথার্থ উত্তম-চর্চা কখনও হয়নি।
প্রতি বছর ৩রা সেপ্টেম্বর আসে। আসে ২৪শে জুলাই। আমরা মহানায়ককে “ঠাকুর”বানিয়ে আড়ম্বর করে আরাধনা করি। তাঁর নাম নিয়ে কতো পুরস্কার, কতো মিডিয়া পাবলিসিটি ! অথচ এতো বছরেও তাঁকে নিয়ে কোনো আর্কাইভ তৈরি হলোনা, তাঁর ছবিগুলোর সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা হলো না। ফিল্ম-স্টাডিজে তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি নিয়ে কোনো পড়াশোনা হল না। আমাদের কোন দায় নেই, কোনও সরকারের কোন দায়িত্বও নেই। তারপরে আবার যেকোনো শিল্পীর যোগ্যতা বিচার হয় রাজনৈতিক রঙ দিয়ে!!
খানিকটা ক্ষোভে, দুঃখে মহানায়ককে নিয়ে একটি ডকু-ফিচার ছবির কাজে হাত দিলাম, “যেতে নাহি দিবো”! কতো বাধা, কতো সমালোচনা। এমন সমালোচনা – যেন বিভিন্ন চরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজেদের উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন ঘোষণা করেছেন !! অতি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছি- কোথাও কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি। ক্রিয়েটিভ কোনো বক্তব্য, কোনো পরামর্শ পাইনি। শুধু সমালোচনা…। যাঁরা কেক, পায়েস দিয়ে মহানায়কের জন্মদিন উদযাপন করেন- তাঁরা শুধুমাত্র ট্রেলার দেখেই সমালোচনায় মুখর হলেন- ছবিতে “সুপ্রিয়া দেবী”বলা হয়েছে কেন?
ভাবতেও অবাক লাগে- সেই যুগে ছিল না ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া। তবু নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতকে “আলোর ঠিকানা”দেখিয়েছিলেন। তাঁর অভিনয়-কুশলতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি আজও। আজও চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি একটা রেফারেন্স। আগের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে আছেন আমাদের মননে, স্মরনে।
Be First to Comment