Press "Enter" to skip to content

২০১০ সালে এক জনমত সমীক্ষায় ‘দশকের সেরা বাংলা চলচ্চিত্রকার’ নির্বাচিত হন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পরিচালক ও অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ………..

Spread the love

জন্মদিনে স্মরণঃ ঋ তু প র্ণ ঘো ষ

বাবলু ভট্টাচার্য : নব্বই দশকের পর সত্যজিৎ-পরবর্তী বাঙালিকে হলমুখী করে তুলেছিল তার চলচ্চিত্র। মধ্যবিত্ত বাঙালি সেখানে খুঁজে পেয়েছিল তাদের চেনা ছবির গল্প এক অচেনা আঙ্গিকে। কিন্তু এই চেনা গল্পের পরিসরে তিনি তার জ্ঞানচর্চার ওজস্বিতায় লুকিয়ে রাখা, এড়িয়ে চলার ভাষাকে, অবহেলার ছবিকে দর্শকদের সামনে এনে হাজির করতেন, তখন তার সেই সৃষ্টি তৈরি করত এক সামাজিক স্বর। যে-স্বরের স্পর্ধিত কণ্ঠে প্রান্তিক মানুষ আজ মেইনস্ট্রিম সিনেমার বিষয় হয়ে ঘুরে ফিরছে। বাংলা ছবির এই আনকোরা ‘আধুনিক’ দিকের দিকপাল ঋতুপর্ণ ঘোষ। যা ভাবতেন তা অন্যকে ভাবাতেও জানতেন। টলিউড থেকে বলিউড, যে-কোনো অভিনেতার কাছ থেকে নিজের দাবিগুলোকে টেনে বার করে আনার ক্ষমতা তার ছিল। তার নিজের ভেতরের মানুষ যেদিন নিজের শরীরের ভাষা বদলাতে চাইল, মন চাইল নিজের শরীর বদল করে কাজল চোখে, কেতাবি জোব্বায় আর পাগড়িতে রঙিন করতে— সেদিন ঝড় উঠেছিল। তিনি তার পরোয়া করেননি। তিনি ঝড়কে সাথি করেছিলেন। আর সেই সঙ্গিনী ঝড়ই মন টেনেছে বাংলা ছবির এই সর্দারকে, নিয়ে গেছে দিগন্তের পারাবারে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথমে সাউথ পয়েন্ট স্কুল এবং পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে শিক্ষালাভ করেন। কর্মজীবনের শুরু বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজের মধ্যে দিয়ে। ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তার সমান দক্ষতা ছিল। চিত্রনাট্যের ওপরে খুবই জোর দিতেন। চিত্রনাট্যনির্ভর ন্যারেটিভ চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।কিংবদন্তি পরিচালক ইংমার বার্গম্যান ও সত্যজিৎ রায়কে আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। মূলত বাংলা চলচ্চিত্রই বানাতেন। ১৯টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি মাত্র দুটি। ২০১০ সালে এক জনমত সমীক্ষায় ‘দশকের সেরা বাংলা চলচ্চিত্রকার’ নির্বাচিত হন ঋতুপর্ণ ঘোষ। অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিলেও মনে করেছেন, তুলনামূলক সাহিত্য বা ইতিহাস পড়লেই ভালো করতেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জানাশোনা পারিবারিক আবহে। বাবা সুনীল ঘোষ ছিলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, মা চিত্রকর। ঋতুপর্ণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে শুটিংয়ে যেতেন। ওই বয়সেই ক্যামেরা চালানো শিখে যান। সম্পাদনা, চিত্রনাট্য লেখার হাতেখড়িও হয় তখন। সব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য নিজেই লিখেছেন। নিজেকে মনে করতেন ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার ‘অন্যমত’। বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণে বেশি মনোযোগী থাকার বিষয়ে তার উক্তি ‘আমি বাংলায় খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমার মূলও এতেই শক্ত।’

নিজেই নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ। লেখক, পরিচালক, অভিনেতা সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল বিতর্কিত নায়ক। বাঙালির মনোজগৎকে সেলুলয়েডে বন্দি করে তার সৃষ্টি আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে বাংলা ছবিকে পৌঁছে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের টেক্সট নিয়ে যখন কাজ করেছেন, সেখানে সহজেই মেলোড্রামা এসে যাওয়ার যে-প্রবণতা থাকে তা খুব চমৎকারভাবে এড়িয়ে গেছেন তিনি। মহাভারত যাতে কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ হয়ে পড়ে না থাকে সে-কথা মাথায় রেখে আজকের জীবনের মধ্যে মিশিয়ে তৈরি করেছেন ‘চিত্রাঙ্গদা দ্য ক্রাউনিং উইশ’। ১৯৯৪ সালে ‘হীরের আংটি’ দিয়ে সিনে মহলে আত্মপ্রকাশ। ওই একই বছর মুক্তি পেয়েছিল ‘উনিশে এপ্রিল’। ১৯৯৫ সালে ‘বেস্ট ফিচার ফিল্ম’ হিসেবে জাতীয় পুরস্কার জিতে নিল তরুণ পরিচালকের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। দৌড় শুরু। বৌদ্ধিক মনন, নান্দনিকতার সিগনেচার মার্ক হয়ে ওঠার লিফটে উঠে পড়লেন ঋতুপর্ণ। এরপর ‘দহন’ (৯৮), ‘বাড়িওয়ালি’ ও ‘অসুখ’ (৯৯), ‘উৎসব’ (০১), ‘শুভ মহরৎ’, (০৩), ‘চোখের বালি’ (০৪), ‘রেইনকোট’, ‘দোসর’ (০৫), ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ (০৮), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (০৯), ‘আবহমান’ (১০), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১২)— তার ঝুলিতে এনে দিয়েছে জাতীয় পুরস্কারের সম্মান।

এছাড়াও কলাকার পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৭ সালে ‘উনিশে এপ্রিল’ ও ২০১১ সালে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-এর জন্য। বম্বে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ১৯৯৯ সালে ‘অসুখ’ ও ২০০২ সালে ‘তিতলি’র জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০০০ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অ্যাওয়ার্ড এনে দিয়েছে তার পরিচালিত ‘বাড়িওয়ালি’। লোকার্নো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ২০০৩ সালে ‘চোখের বালি’, ২০০৫ সালে ‘অন্তরমহল’-এর জন্য সম্মানিত হয়েছেন। পরিচালনার পাশাপাশি দক্ষ অভিনেতা ছিলেন তিনি। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ ও ‘চিত্রাঙ্গদা’য় অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষের অনন্য অভিনয়-প্রতিভার সাক্ষী থেকেছেন সিনেমাপ্রেমীরা। এছাড়া দুটি বহুল প্রচলিত বাংলা ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবেও দাপটে কাজ করেছেন তিনি।

২০১৩ সালের ৩০ মে তার কলকাতার বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু ঘটে।

ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৬৩ সালের আজকের দিনে (৩১ আগস্ট) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.