স্মরণঃ পি সি (প্রতুল চন্দ্র) স র কা র
বাবলু ভট্টাচার্য : শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, পৃথিবীতে বোধহয় এমন দেশ নেই, যেখানকার শিক্ষিত মানুষেরা জাদুকর পি সি সরকারের নাম জানেন না। সারাবিশ্বে শুধু জাদু দেখিয়েই তিনি গোটা বাঙালি জাতির জন্য কুড়িয়ে এনেছেন সুনাম আর গৌরব।
পি সি সরকারের পুরো নামটি হচ্ছে প্রতুলচন্দ্র সরকার। তিনি ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার আশেকপুর নামে ছোট্ট একটা গ্রামে। পিতা ভগবানচন্দ্র সরকার এবং মা কুসুমকামিনী দেবী। প্রচন্ড দারিদ্রের মধ্যে শৈশব কাটে তার।
টাঙ্গাইলের স্থানীয় শিবনাথ হাইস্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু। বাল্যকাল থেকেই জাদুবিদ্যার প্রতি কৌতূহল এবং কিছুটা বংশগত ঐতিহ্যও তাকে এ পেশায় আগ্রহী করে তোলে। গণপতি চক্রবর্তী ছিলেন তার জাদুবিদ্যার গুরু। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি জাদু দেখানো শুরু করেন এবং কলেজে অধ্যয়নকালে পুরোপুরি এর প্রাকটিস শুরু করেন। তবে সাধারণ লেখাপড়া এতে বাধাগ্রস্ত হয়নি।
প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হন করটিয়া সাদত কলেজে। তখন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ ইব্রাহিম খাঁ। কলেজে এসেও চলল জাদুর ওপর পড়াশোনা আর চর্চা। সারা কলেজে তখন তার প্রচুর নাম ডাক। চায়ের দোকানে, খেলার মাঠে সকলের মুখে মুখে প্রতুলের অদ্ভুত জাদুর খেলার প্রশংসা।
এমন সময় একদিন সাদত কলেজ পরিদর্শন করতে এলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সপেক্টর ড. হরেন মুখার্জি এবং তার সঙ্গে এলেন কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মি. হার্লে। তাদের আগমন উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয়, প্রতুলের জাদু প্রদর্শনীর। প্রতুল অনুষ্ঠানে এমন সব চমৎকার জাদুখেলা দেখালেন যে, তারা দুজনেই খুব মুগ্ধ হন।
করটিয়া কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ‘হিপ্নোটিজম’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। তখনকার করটিয়া কলেজ ছিল ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। তাই ১৯৩১ সালে আইএ পাস করে ডিগ্রী পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি অংকে অনার্স নিয়ে বিএ পরীক্ষা দেন।
আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘ম্যাজিক শিক্ষা’ নামে আরও একটি বই লেখেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি জাদুকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
এরপর তিনি কলকাতায় পাড়ি জমান। প্রথমে ওঠেন তিনি ভাড়া বাড়িতে। পরে নিজেই বাড়ি করেন কলকাতার বালিগঞ্জে। অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতা শহরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নিয়মিত জাদুর অনুষ্ঠান করতে লাগলেন, আর সেই সঙ্গে পত্র-পত্রিকাতে শুরু করলেন জাদু বিষয়ে লেখালেখি। দুদিকেই তার খ্যাতি বাড়তে লাগল।
১৯৫৭ সালে পি সি সরকার লন্ডনের বিবিসি টেলিভিশনে করাত দিয়ে এক তরুণীকে কেটে টুকরো করে দেখিয়ে ছিলেন। এতে বহু টেলিভিশন দর্শক অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। পরের দিন লন্ডনের বড় বড় পত্রিকা এই লোমহর্ষক ও বিস্ময়কর খেলার খবরের সচিত্র বিবরণ প্রকাশ করে।
এই বিস্ময়কর খেলা দেখানোর পরপরই ১৯৫৭ সালের ২২ মে পি. সি. সরকারকে আমেরিকা টিভি কোম্পানিগুলো বিশেষ বিমানে করে নিয়ে যায় তাদের দেশে। ১৯৬৭ সালে তিনি আবার আমেরিকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ লাভ করেন। এই সময় তিনি আন্তর্জাতিক রোটারি ক্লাবের সদস্য এবং বিলেতের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন ফেলো নির্বাচিত হন।
জাদুসম্রাট পি সি সরকারের পারিবারিক জীবন ছিল অত্যন্ত সুশৃংখল ও শান্তিময়। ১৯৩৮ সালে তিনি টাঙ্গাইলের বিখ্যাত চিকিৎসক প্রমথনাথ গুহ মজুমদারের প্রথম কন্যা বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন। বাসন্তী দেবী ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী।
জাদুশিল্পে পি.সি সরকারের কৃতিত্ব হলো তিনি বহু প্রাচীন জাদুখেলার মূল সূত্র আবিষ্কার করেন। ‘এক্স-রে আই’, ‘করাত দিয়ে মানুষ কাটা’, ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি তার জনপ্রিয় খেলা। ১৯৩৪ সালে তিনি বিদেশ গমন করেন এবং ৭০টির মতো দেশে জাদু প্রদর্শন করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।
তার জাদু বিভিন্ন দূরদর্শনে যথা অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন, বিবিসি, শিকাগোর ডব্লিউজিএন টিভি এবং নিউইয়র্কের এনবিসি ও সিবিএস টেলিভিশনে বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। ১৯৫৭ ও ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় এবং ১৯৬২ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো ও লেনিনগ্রাদ শহরে জাদু প্রদর্শন করে তিনি বিপুল সুনাম অর্জন করেন। পি সি সরকারই প্রথম রাজকীয় পোশাক এবং আকর্ষণীয় পাগড়ি পরে জাদু প্রদর্শনের প্রচলন করেন।
জাদু দেখিয়ে পিসি সরকার দেশে-বিদেশে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেজ ম্যাজিকের জন্য আমেরিকার জাদুবিদ্যার নোবেল প্রাইজ বলে খ্যাত ‘দি ফিনিক্স অ্যাওয়ার্ড’ তিনি দুবার লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘গোল্ডবার’ পুরস্কার, ‘সুবর্ণ লরেল মালা’ নামে জাদুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জার্মান পুরস্কার, হল্যান্ডের ‘ট্রিক্স পুরস্কার’ এবং ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি লাভ করেন।
চালু হয়েছে তার সম্মানে নতুন পোস্টাল স্ট্যাম্প। জাদুখেলার কৃতিত্বের জন্য মায়ানমারের (বার্মার) প্রধানমন্ত্রী থাকিন নু তার নাম দিয়েছিলেন ‘এশিয়ার গৌরব’।
জাদুশিল্পে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য বিশ্ববাসীর কাছ থেকে তিনি ‘জাদুসম্রাট’ ও সর্বকালের ‘শ্রেষ্ঠ সম্রাট’ উপাধি লাভ করেন।
বালিগঞ্জের তার বাসভবনের পাশের একডালিয়া সড়কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পিসি সরকার সরণি।
পি সি (প্রতুল চন্দ্র) সরকার ১৯৭০ সালের আজকের দিনে (৬ জানুয়ারি) জাপান সফরকালে মৃত্যু বরণ করেন।
Be First to Comment