স্মরণ : ক বি শ ক্তি চ ট্টো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : সাহিত্যজীবনের শুরুটা পদ্য নয়, গদ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসই তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ১৯৫৬-৫৭ এর দিকে এটি রচিত হয় এবং ১৯৬১ সালে প্রকাশিত। প্রথমদিকে তিনি উপন্যাস লিখে অর্থ রোজগারের চিন্তা করলেও পরে তার সমগ্র সত্ত্বাই যেন ঝুঁকে পড়ে কবিতার দিকে।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বহড়ু গ্রামে ১৯৩৩ সালের ২৫ নভেম্বর জন্ম নেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তার পিতা ছিলেন বামানাথ চট্টোপাধ্যায়, যিনি শক্তির মাত্র চার বছর বয়সেই পরলোকগমণ করেন। তার মা কমলা দেবী। বাবার মৃত্যুর পর মাতামহই তার অভিভাবকরূপে অবতীর্ণ হন।
১৯৪৮ সালে শক্তি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন কাশিমবাজার পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে, তখনই এক শিক্ষকের কাছে মার্ক্সবাদের প্রথম পাঠ পেলেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) তে। বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্যে ভর্তি হলেও পরীক্ষায় না বসার কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।
১৯৫৬ সালে বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা- ‘যম’। এরপর তিনি কৃত্তিবাস সহ অন্যান্য সাহিত্যপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসুর আমন্ত্রণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের উপর একটি কোর্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু অনাগ্রহের দরুণ সেটাও শেষ করতে পারেননি।
তার লেখা ‘কিন্নর ও কিন্নরী’ উপন্যাসটি প্রকাশ পায় ১৯৭৭ সালে। এটি ছাড়াও ‘অম্বা ও দেবব্রত’, ‘রামচন্দ্র ও শর্বরী’, ‘সোম ও তারা’, ‘অর্জুন ও উত্তরা’ নামক চারটি ব্যর্থ প্রেমের উপন্যাস তিনি উপহার দেন বাংলা সাহিত্যকে। উল্লেখ্য, এই উপন্যাসগুলোর সবগুলোই পৌরাণিক চরিত্র কেন্দ্রিক।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি হাংরি বুলেটিনে শক্তির কবিতা বেরুতো এবং তিনি এ আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তার ডাকেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার প্রমুখ। কিন্তু পরে আন্দোলন থেকে তার দূরে সরে যাওয়া এমনকি নিজেকে নিরাপদে রাখতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তার কিছু কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়।
তার কিছু কাব্যগ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলোঃ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’, ‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো’, ‘সোনার মাছি খুন করেছি’, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’, ‘ঈশ্বর থাকেন জলে’, ‘অস্ত্রের গৌরবহীন একা’, ‘জ্বলন্ত রুমাল’, ‘ছিন্নবিচ্ছিন্ন’, ‘সুন্দর এখানে একা নয়’, ‘কবিতায় তুলো ওড়ে’, ‘ভাত নেই পাথর রয়েছে’, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’, ‘আমাকে জাগাও’, ‘ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে’, ‘সকলে প্রত্যেকে একা’।
১৯৮৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারসহ তিনি বেশ কিছু পুরস্কার পান।
সকলের সাথে চেনাজানা সম্পর্কের বাইরে নিজের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বড্ড কষ্ট পেতে হতো শক্তিকে। দিনশেষে কুরে খাওয়া নিঃসঙ্গতাকে তিনি অস্বীকার করতে পারতেন না। কখনো না কখনো অন্যের সাথে তার আচরণেও প্রকাশ পেতো দীর্ঘশ্বাস।
বোহেমিয়ান এই কবির যখন একটা আশ্রয় লাগতো, তখন হয়তো কারো দরজায় এভাবেই করাঘাত করতে চাইতেন, আবার হয়তোবা নিজের দরজার দিকেই তাকিয়ে থাকতেন একবার একটি করাঘাতের কামনায়। ভাবনা ও ভাষার বৈপরীত্যপূর্ণ সংঘাতে ভেসে ওঠে কিছু কথাঃ
“দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
অবনী বাড়ী আছো?”
১৯৯৫ সালের আজকের দিনে (২৩ মার্চ) শক্তি চট্টোপাধ্যায় কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment