————জন্মদিনে স্মরণঃ শম্ভু মিত্র————-
বাবলু ভট্টাচার্য : আমরা জানি থিয়েটার দলগত শিল্প। তবুও ব্যক্তি তার অনন্য প্রতিভার গুনে থিয়েটারে যুগচিহ্ন হয়ে যান কখনো কখনো, তাও আমরা জানি। বাংলা থিয়েটারের আড়াইশ’ বছরের পরম্পরায় একটা দীর্ঘ সময়কে ‘গিরিশ যুগ’ এবং তার পরের সময়কালটিকে ‘শিশির যুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। শিশির যুগের শেষ লগ্নে এলেন আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের অনন্য প্রতিভা শম্ভু মিত্র। তিনি ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যজগতের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী ও চলচ্চিত্র অভিনেতা। ১৯৩৯ সালে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে যোগ দেন। পরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হন। ১৯৪৮ সালে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন নাট্যসংস্থা ‘বহুরূপী’। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বহুরূপীর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সফোক্লিস, হেনরিক ইবসেন, তুলসী লাহিড়ী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট নাট্যকারের রচনা তাঁর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। ১৯৩৯ সালে রংমহলে যোগদানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে তাঁর পদার্পণ। পরে যোগ দিয়েছিলেন মিনার্ভায়। নাট্যনিকেতনে ‘কালিন্দী’ নাটকে অভিনয়ের সূত্রে সে যুগের কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হয়। পরবর্তীকালে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর প্রযোজনায় ‘আলমগীর’ নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন।
১৯৪৩ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি. সি. যোশির অনুপ্রেরণায় যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। ১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্বর গণনাট্য সংঘে কাজ করার সময়ই প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন শম্ভু মিত্র। ১৯৭৬ সালে নাটক ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ‘ম্যাগসেসে’ পুরস্কার ও ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে এক বছরের জন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় নান্দীকার প্রযোজিত ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় বিশেষ সাড়া ফেলেছিল। ১৯৮০-৮১ সালেফ্রিৎজ বেনেভিৎজের পরিচালনায় ক্যালকাটা রিপোর্টারির প্রযোজনায় ‘গ্যালিলিওর জীবন’ নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৮৩ সালে নিজের প্রযোজনায় কন্যা শাঁওলী মিত্র পরিচালিত ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটকে কন্যার সঙ্গে অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র। শাঁওলী মিত্রের পরবর্তী নাটক ‘কথা অমৃতসমান’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন শম্ভু মিত্র।
১৯৮৩ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে সম্মানিত করে। যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত করেছিল। নাট্যরচনা ছাড়াও শম্ভু মিত্র পাঁচটি ছোটগল্প ও একাধিক নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ ও ‘প্রসঙ্গ : নাট্য’ দুটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ।শম্ভু মিত্র ছিলেন বাংলার এক স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘মধুবংশীর গলি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি জনসমাজে বিশেষ সাড়া ফেলেছিলেন। ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’, ‘ডাকঘর’, ‘চাঁদ বণিকের পালা’ ও ‘অয়দিপাউসের গল্প’ তাঁর স্বকণ্ঠে রেকর্ড করা নাট্যপাঠ। এছাড়া শম্ভু মিত্র (কবিতা আবৃত্তি), রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠ, দিনান্তের প্রণাম তাঁর প্রসিদ্ধ বাংলা কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড।নাট্যাভিনয়ের সূত্রে চলচ্চিত্র জগতেও পা রেখেছিলেন শম্ভু মিত্র। খাজা আহমেদ আব্বাসের পরিচালনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ‘ধরতি কে লাল’-এর সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন ‘মানিক’, ‘শুভবিবাহ’, ‘৪২’, ‘কাঞ্চনরঙ্গ’, ‘পথিক’, ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে।
অমিত মিত্রের সঙ্গে ‘একদিন রাত্রে’ ও তার হিন্দি ‘জাগতে রহো’-র কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনার কাজ করেন। রাজ কাপুর প্রয়োজিত ও অভিনীত ‘জাগতে রহো’ ছবিটি গ্রাঁ পিঁ সম্মানে ভূষিত হয়েছিল।
১৯৯৭ সালের কলকাতার বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শম্ভু মিত্র।
শম্ভু মিত্র ১৯১৫ সালের আজকের দিনে (২২ আগস্ট) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment