স্মরণঃ ক ম ল মি ত্র
বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলা ছবির রাশভারী কর্তা ইমেজটাই তাঁর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। যেমন লম্বা-চওড়া চেহারা, তেমনই গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর সেরকমই ব্যক্তিত্ব তাঁর। তিনি কমল মিত্র। ব্যাকব্রাশ করা চুল, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা আর মুখে পাইপ, তাঁর এই চেহারাটাই বাঙালির চোখে ধরা আছে।
তাঁর পরিবারের কেউই কখনও অভিনয় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু বিগত শতকের বিশের দশক ধরে বহু চেষ্টায় কমল মিত্র চলচ্চিত্র ও রঙ্গালয়ের এক সাধারণ অভিনেতা থেকে অ-সাধারণ একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন।
১৯১২ সালের ৯ ডিসেম্বর কমল মিত্রর জন্ম বর্ধমান শহরে। তাঁর পিতামহ ডাক্তার জগদ্বন্ধু মিত্র ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরোধে যিনি হুগলি জেলার চাঁদরা গ্রাম থেকে বর্ধমানে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর খ্যাতি এতটাই ছড়িয়েছিল যে, পঞ্চম জর্জ ভারতে এসে তাঁকে ‘দরবারি মেডেল’ প্রদান করেছিলেন।
সেই ‘চাঁদরার মিত্র’ বংশের কৃতি সন্তান কমল। তাঁর বাবা নরেশচন্দ্র মিত্র ছিলেন বর্ধমানের প্রখ্যাত আইনজীবী ও বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান।
কমল মিত্রর পড়াশোনা বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজে। ছাত্রাবস্থা থেকেই তখনকার বর্ধমান শহর ও তার আশপাশে ছোট-বড় নানা শৌখিন দলের নাটকে তিনি ছিলেন স্টার অভিনেতা। বিভিন্ন দল তাদের নাটকে অভিনয় করার জন্য তাঁকে সাদরে নিয়ে যেত।
কলেজ পাশ করার পরই চোখের অসুখে বাবা দৃষ্টিহীন হয়ে পড়লে কমল মিত্রকে চাকরির সন্ধানে বেরোতে হয়। বাড়ির কাউকে না জানিয়েই তিনি সামরিক বাহিনীতে নাম লেখান। যদিও বাবার তীব্র আপত্তিতে সে কাজ তাঁর আর করা হয়নি। কারণ, বড় ভাই মারা যান অল্প বয়সে। মিলিটারিতে যোগ দিলে ছোটো ছেলেও মারা যাবে, তাঁর মায়ের এমন একটা আশঙ্কা ছিল বলে, তাঁর বাবা বর্ধমান মহারাজাকে ধরে তাঁর নাম কাটিয়ে দেন।
পরবর্তী কালে কমল মিত্র সরকারি কালেক্টরেটে চাকরি পান। দীর্ঘ এগারো বছর সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তাঁর সেই চাকরি স্থায়ী ছিল না।
বিশের দশকে ছাত্র অবস্থাতেই কমল মিত্র কলকাতায় আসা-যাওয়া শুরু করে দেন। উদ্দেশ্য, সাধারণ রঙ্গালয় বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ খোঁজা।
১৯৪৩ সালে দেবকী বসুর ‘শ্রীরামানুজ’ ছবি দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্র অভিনয়ের যাত্রা শুরু। ১৯৪৫ সালে দেবকী বসুর পরের হিন্দি ছবি ‘স্বর্গ সে সুন্দর মেরা দেশ’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। ওই বছরই নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘বনফুল’। এটিও হিন্দি ছবি।
১৯৪৫ সালের পর থেকে কমল মিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালকদের কাছে নতুন প্রতিভা হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। দেখা যাচ্ছে দেবকী বসুর সঙ্গে-সঙ্গে নীরেন লাহিড়ী, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় (‘সংগ্রাম’ ১৯৪৬), অপূর্বকুমার মিত্র (‘তুমি আর আমি’ ১৯৪৬) হেমেন গুপ্ত (‘অভিযাত্রী’ ১৯৪৭), অগ্রদূত (‘সমাপিকা’ ১৯৪৮) ও তাঁদেরই ছবি ‘সব্যসাচী’তে একেবারে নামভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন।
১৯৪৪ সালে অভিনেতা বিপিন গুপ্তর সুপারিশে তিনি স্টার থিয়েটারে যোগ দেন। স্টারে তখন মহেন্দ্র গুপ্ত রচিত ও পরিচালিত ‘টিপু সুলতান’ নাটক অভিনীত হচ্ছিল। সে নাটকে তিনি ব্রেথওয়েট চরিত্রে অভিনয় করতে সর্বপ্রথম কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয় মঞ্চে অবতীর্ণ হন। এই নাটকই তাঁকে সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনেতার সম্মান এনে দেয়। এর পরই তিনি কালেক্টরেটের সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা করে নেন।
চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে অভিনয়ের কারণে কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কলকাতার ১ নং শিবশঙ্কর লেনের বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন কমল মিত্র। খাওয়া বলতে কলকাতার পাইস হোটেলের কম পয়সার দু’বেলার খাবার।
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কমল মিত্র একাধারে যেমন ‘নীলাঙ্গুরীয়’, ‘শ্রীরামানুজ’, ‘বনফুল’, ‘সংগ্রাম’, ‘তুমি আর আমি’, ‘পূর্বরঙ’, ‘অভিযাত্রী’ ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেছেন, তেমনই ওই একই সময়ে ‘টিপু সুলতান’, ‘কেদার রায়’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘সীতারাম’ নাটকে অভিনয় করে একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
সেই খ্যাতির কারণেই স্টার থিয়েটারের অভিনেতা হলেও সুকুমার দাশগুপ্ত তাঁকে ‘সাত নম্বর বাড়ি’-তে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। এই ছবিতেই কমল মিত্র প্রথম ও শেষ হেমন্তমুখার্জির প্লে-ব্যাকে দু’টি গানে লিপ দিয়েছিলেন।
কমল মিত্র অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে আছে ‘কংস’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘আনন্দমঠ’, ‘জিঘাংসা’, ‘সব্যসাচী’, ‘লৌহকপাট’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘সবার উপরে’, ‘বন্ধু’, ভানু পেল লটারী’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘পিতাপুত্র’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘বর্ণালী’ ইত্যাদি।
দেবকীকুমার বসু থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমার আদি যুগের বহু খ্যাতিমান পরিচালকের ছবিতে যেমন কাজ করেছেন, তেমনই পরবর্তী কালে অজয় কর, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, রাজেন তরফদার এমনকী সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোটো একটি পার্টির দৃশ্যেও তিনি ছিলেন স্ব-মহিমায়।
নাট্যচার্য শিশিরকুমার তাঁকে বলেছিলেন, ‘কমল নোট মুখস্ত করে এম এ পাশ করা যায়, কিন্তু যে লাইনে তুমি ঢুকেছ, এখানে শেখার শেষ কোনও দিন হবে না, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে শিখতে হবে।’ কথাটা কমল মিত্র আজীবন মনে রেখেছিলেন।
দেশ বিদেশের নানা বই জোগাড় করে অভিনয়কলাকে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন আশ্চর্য নিষ্ঠায়। চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা। শেষ বয়সে তাঁর সারা জীবনে সংগৃহীত বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার কলকাতার নন্দনের লাইব্রেরিতে দান করে দেন, কেবল চ্যাপলিনের আত্মজীবনীটি ছাড়া।
শেষ দিকে কমল মিত্র ক্রমশ একা হয়ে পড়েছিলেন। বলতেন, “প্রায় সব সহশিল্পী চলে গেল। এমনকী যারা বয়সে আমার ছোট তারাও রইল না। ছবি, পাহাড়ি, জহর (গাঙ্গুলি), অসিতবরণ, বিকাশের সঙ্গে অনেক বছর ধরে কাজ করেছি। সেটে আর তারা আসবে না, এই কথা যখন ভাবি তখন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে। এমনকী উত্তম, ভানু, জহরও চলে গেল।
কাউকে কিছু না জানিয়েই কমল মিত্র সরে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনয় জগৎ থেকে। যেমন অনাহুতের মতো তাঁর আগমন ঘটেছিল বাংলার চলচ্চিত্র ও রঙ্গালয়ে, তেমনই অনাড়ম্বর ছিল তাঁর প্রস্থান।
নিজের মৃত্যুর মুহূর্তকে কমল মিত্র আশ্চর্য ক্ষমতায় বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের শ্রাদ্ধশান্তির যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের উপর কড়া নির্দেশ ছিল, কোনও ভাবেই যেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া না হয়।
তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে উপস্থিত স্ত্রী, মেয়ে, জামাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে, শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে উপস্থিত সকলের কাছে জীবনে স্বকৃত কোনও অজানা অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, মৃত্যুর কোলে যেন সজ্ঞানেই ঢলে পড়েছিলেন। ঠিক যেমনটি বাংলা সিনেমায় হয়!
কমল মিত্র ১৯৯৩ সালের আজকের দিনে (২ আগস্ট) ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment