জন্মদিনে স্মরণঃ জগদীশ গুপ্ত
“মানুষের প্রেমের ট্র্যাজেডি মৃত্যুতে নয়, বিরহে নয়, অবসাদে আর ক্ষুদ্রতার পরিচয়ে, আর উদাসীনতায়।”
——– জগদীশ গুপ্ত
বাবলু ভট্টাচার্য : বাজারে যাওয়ার ভয়ে জগদীশ গুপ্ত নাকি সাত-সকালেই লিখতে বসে যেতেন। স্ত্রী এসে দেখতেন, গভীর মনোযোগের সঙ্গে স্বামী লেখালেখি করছেন। তা দেখে স্ত্রীর খুব গর্ব হতো, কী বিদ্বান তাঁর স্বামী— ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই ফের লেখা নিয়ে বসেছেন! স্বামীকে বিরক্ত না করে আস্তে নীরবে সরে যেতেন তিনি। অন্য কাউকে দিয়ে বাজার করিয়ে নিতেন।
জগদীশ গুপ্ত ছিলেন ভারত উপমহাদেশের অন্যতম বাঙালি ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। তিনি মূলত কথাসাহিত্যিক হলেও সাহিত্যিক জীবনের শুরুতে কবিতা লিখেছেন ও একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছেন।
পেশা হিসাবে টাইপিংকেই বেছে নেন তিনি। কর্মসূত্রে ছিলেন সিউড়িতে, ওড়িশার সম্বলপুরে এবং পটনা হাইকোর্টে। পরের অধীনে চাকরি করতে গেলে বহু অন্যায় কাজও অনেক সময় মেনে নিতে হয়। জগদীশ গুপ্তের মতো প্রখর মর্যাদা জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না।
উপরওয়ালা ইংরেজের সঙ্গে তাঁর মতান্তর হয় একটি ইংরেজি শব্দ নিয়েই। সাধারণ এক টাইপিস্টের ‘ঔদ্ধত্য’ শ্বেতাঙ্গ কর্তার সহ্য হয়নি। জগদীশ যে শুধু পটনা হাইকোর্টের চাকরি ছাড়লেন তা-ই নয়, জীবনে আর কখনও চাকরি করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নিলেন।
চাকরির বিকল্প হিসাবে তিনি বেছে নিলেন ব্যবসাকে। কুষ্টিয়াতে ফিরে প্রথমে একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন বলে ঠিক করলেন। সেই পত্রিকা প্রকাশিত হলেও তা থেকে আয় খুব বেশি হল না। এর পর যেটুকু পুঁজি অবশিষ্ট ছিল, তার সবটাই বিনিয়োগ করে শুরু করলেন ফাউন্টেন পেনের কালি তৈরির ব্যবসা। কিন্তু ব্যবসা চালানোর জন্য যে বৈষয়িক বুদ্ধির দরকার হয়, তা তাঁর একেবারেই ছিল না।
১৯২৭ সালে এলেন বোলপুরে, অর্থের বিনিময়ে মক্কেলদের কোর্টের দরকারি কাগজপত্র টাইপ করে দিতেন। সেই সময় অনেকেই বলেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি তিনি।
১৯৩১ সালে ‘লঘু গুরু’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে এক কপি বই রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বইটির দীর্ঘ সমালোচনা করেন রবীন্দ্রনাথ।
জগদীশ গুপ্তের অনেক রচনাই ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, গল্প তৈরি তাঁর উদ্দেশ্য নয়। লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি শুধুমাত্র নিজের বক্তব্য পরিবেশন করেছেন।
তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় একশো পঁচিশ। মানুষের যেমন হওয়া উচিত, অথবা যেমন হলে তাকে আমাদের ভালো লাগে তা নয়, মানুষ প্রকৃতই যা, তার বিশ্বস্ত ছবি একেবারে নির্মোহ দৃষ্টিতে আঁকতে চেয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, শরৎচন্দ্রের মিলিত প্রয়াসে, মানুষের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে সাহিত্যরুচি গড়ে উঠেছিল, জগদীশ গুপ্ত তা থেকে সরে এলেন। ভাববাদী ধারার সত্য, মঙ্গল ও নৈতিকতার মতো বিষয়গুলো আসলে যে কতটা মিথ্যা আর বানানো, তা দেখালেন। প্রবেশ করলেন মানুষের অবচেতনায়, মনের গহনতম প্রদেশে; দেখালেন পাপবোধ ও কদর্যতা মেশানো তার প্রকৃত স্বরূপকে। আর এ সবই দেখালেন বাস্তবতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে।
শার্ল বোদল্যের ফরাসি কাব্যে প্রথম যা করে দেখিয়েছিলেন, বাংলা গল্প-উপন্যাসে সেটাই করে দেখালেন জগদীশ গুপ্ত। জীবনের অশুভ দিকগুলোকে স্বীকৃতি দিলেন, দেখালেন বেআব্রু করে।
জীবনের সমস্ত মেকি আবরণ টেনে ছিঁড়ে আপসহীন ভাবে দেখিয়েছেন তার ভেতরের সত্যকে। সত্যের সাধনাতেই তিনি কাটিয়ে গেছেন গোটা জীবন। তাঁর লেখা তাই আমাদের স্বস্তি দেয় না। তিনি আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন।
লেখার জন্য জীবনে কখনও আপস করেননি তিনি। এক প্রকাশক তাঁর একটি উপন্যাসকে আরও খানিকটা বাড়াতে বলে একটা চিঠি লিখেছিলেন। অগ্রিম কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেই টাকা ফেরত পাঠিয়ে জানান, ‘যে উপন্যাস যেখানে যখন সমাপ্ত হওয়া প্রয়োজন এবং যে ঘটনা বিস্তারের যতটুকু ক্ষেত্র আছে, তার বেশি কোনো ফরমাসী লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
নিঃসন্তান জগদীশ গুপ্ত একটি মেয়েকে সন্তানস্নেহে পালন করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন সুকুমারী। নিয়মিত ও নিশ্চিত আয় না থাকায় শেষের দিনগুলিতে রীতিমতো অর্থাভাবে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। আর ছিল নানা রোগ– ব্যাধির নিয়ত উপদ্রব। যদিও এই মানুষটিই এক সময় নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন। সাঁতার ছিল তাঁর প্রিয় নেশা।
১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
জগদীশ গুপ্ত ১৮৮৬ সালের আজকের দিনে (৫ জুলাই) কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment