Press "Enter" to skip to content

১৯২০-১৯৫০ সাল পর্যন্ত যে কজন সাহিত্যিক দোর্দণ্ড প্রতাপে বিশ্বসাহিত্যে রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে….।

জন্মদিনে স্মরণঃ আ র্নে স্ট হে মিং ও য়ে

বাবলু ভট্টাচার্য: ১৯২০-১৯৫০ সাল পর্যন্ত যে কজন সাহিত্যিক দোর্দণ্ড প্রতাপে বিশ্বসাহিত্যে রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। হেমিংওয়ের কথাসাহিত্য আজও ইংরেজি কথাসাহিত্যের সর্বাধিক পঠিত।

তাঁর জীবন ছিল দুর্দান্ত। এমন দুর্দান্ত জীবন ও চলন্ত রসদ নিয়ে ক’জন ছুটতে পারে? মাত্র সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোটগল্পের বই ও দুটি অকল্পিত সাহিত্য গ্রন্থ- এই হলো হেমিংওয়ের রচনাসম্ভার।

তবে তিনি সাহিত্যকর্মের বাইরেও অমর হয়ে থাকবেন তাঁর অদ্ভুত জীবনযাত্রার জন্য। বিখ্যাত হয়ে থাকবেন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে সাহিত্যকর্মে নিজের জীবনের ঘটনাবলি ফুটিয়ে তোলার জন্য।

অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তাঁর জীবনের অবসান হতে পারতো মর্টারের আঘাতে। এরপর হাসপাতালেই ভন কুরোস্কি নামের এক সেবিকার প্রেমে পড়া।

কিন্তু জীবনের শেষ চিত্রনাট্য যে তাঁর হাতেই লেখা ছিল। নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সমস্ত কিছুর অবসান করা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাইতো তিনি ‘পাপা হেমিংওয়ে’।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাবা ক্লেরেন্স অ্যাডমন্ডস হেমিংওয়ে ছিলেন চিকিৎসক আর মা গ্রেস হল হেমিংওয়ে ছিলেন অপেরা শিল্পী।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নাম আর্নেস্ট রেখেছিলেন তাঁর নানা। যদিও পরবর্তীতে এই নাম পছন্দ করতেন না হেমিংওয়ে। কারণ অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত নাটক ‘দ্য ইমপোর্টেন্স অব বিয়িং আর্নেস্ট’-এর সেই সাদাসিধে, বোকাসোকা ধরনের প্রধান চরিত্রের নাম ছিল আর্নেস্ট।

১৯১৩ সালে হেমিংওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয়। তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল ওক পার্ক অ্যান্ড রিভার ফরেস্ট হাই স্কুলে। কিন্তু এক বছরের মাথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হেমিংওয়ের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে চলে যান ইতালিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯১৮ সালে মারাত্মক আঘাত পেলেন মর্টারের আঘাতে। আহত হলেন মারাত্মকভাবে।

আহত হেমিংওয়ে ছয় মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ইতালিয়ান সরকার অবশ্য তাকর এই সাহসিকতার জন্য ভূষিত করেন ‘ইতালিয়ান সিলভার মেডেল অব ব্রেভারি’ পদক দিয়ে। হাসপাতালেই হেমিংওয়ে ভালোবেসে ফেলেন এগনেস ভন কুরোস্কি নামের রেডক্রসের এক নার্সকে।

এগনেস আর হেমিংওয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকাতেই হবে তাঁদের বিয়ে। ১৯১৯ সালের প্রথম দিকে হেমিংওয়ে ফিরে গেলেন আমেরিকায়। অপেক্ষা করতে লাগলেন এগনেসের জন্য। কিন্তু হঠাৎ ইতালি থেকে এগনেসের চিঠি এলো। এক ইতালিয়ান অফিসারের সঙ্গে এগনেসের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

সেই কুড়ি বছর বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হলেন হেমিংওয়ে। কিন্তু রসদ জুগিয়ে গেল এই প্রেম ও বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে। পরবর্তীতে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ সৃষ্টি হলো এই প্রেম ও যুদ্ধ নিয়ে।

এসময় তিনি বুঝতে পারেন, চাকরি ছাড়া ঘরে বসে থাকা খারাপ দেখাচ্ছে এবং তাঁর এই অবসাদ থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে হাইস্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মিশিগানের এক দ্বীপে মাছ ধরতে ও ক্যাম্পিং সফরে গিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। এই সফর নিয়ে তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘বিগ টু হার্টেড রিভার।’

১৯২১ সালে হেমিংওয়ে হ্যাডলি রিচার্ডসনকে বিয়ে করে তারা চলে যান ফ্রান্সে। প্যারিসেই শুরু হয় হেমিংওয়ের সাহিত্য। সেখানে হেমিংওয়ের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ প্রকাশিত হলো প্যারিসে থাকাকালীন।

প্যারিসে থাকার সময়েই সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন হেমিংওয়ে। পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে পরিচয় হলো জেমস জয়েস, পাবলো পিকাসো, স্কট ফিটজেরাল্ডের মতো মহারথীদের সঙ্গে।

১৯২৩ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হলো হেমিংওয়ের প্রথম বই ‘থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমস’। প্রকাশক ছিলেন রবার্ট ম্যাকেলমন।

এর কিছুদিন পরেই হ্যাডলির সঙ্গে বিচ্ছেদ হলো হেমিংওয়ের। পরের বছরই হেমিংওয়ে বিয়ে করলেন পলিন ফাইফারকে। বিয়ের কিছুদিন পর লেখা শুরু করলেন তাঁর বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘ম্যান উইদাউট ওমেন।’ স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ফাইফারের সঙ্গেও তাঁর বিচ্ছেদ হলো। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে লিখলেন ‘আ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস’।

এর পরের বছর প্রকাশিত হলো তাঁর আরেক বিখ্যাত উপন্যাস ‘হুম দ্য বেল কোর্স’। এরই মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্পও প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছেন ততদিনে।

১৯৫২ সালে তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সী’ প্রকাশিত হওয়ার পরে হইচই পড়ে গেল চারদিকে। ছোট্ট একটি উপন্যাস। অথচ কি দোর্দণ্ড শক্তিমান বার্তা ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ সান্তিয়াগোকে দিয়ে দিয়েছেন।

এই উপন্যাস প্রকাশের কিছুদিন পর হেমিংওয়ে আফ্রিকায় সাফারি ভ্রমণে গেলেন। সেখানে পরপর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলেন তিনি কিন্তু বাকি জীবনের বেশির ভাগ সময় সেই শারীরিক আঘাত নিয়েই বেঁচে ছিলেন।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কিউবায় স্থায়ী হয়ে গেলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।

নতুন বাড়ি কিনলেন আইডাহোর রাজ্যের কেচামে। তখন তার মধ্যে ভীষণ মানসিক অস্থিরতা। কিছুই লিখতে পারছেন না নতুন করে। কেবল স্মৃতিকথা ছাড়া। সমালোচকেরা বলতো হেমিংওয়ে ফুরিয়ে গেছেন।

হেমিংওয়ে ভীষণ শিকার করতেন। মাঝে মাঝে শিকারে চলে যেতেন কয়েক দিনের জন্য। বড়শিতে মাছ ধরতেন। পাহাড়ে যেতেন হতাশা কাটাতে। কিন্তু তাতেও হতাশা কাটছিল না। লিখতে বসলেই টের পেতেন চারদিকে হতাশা আর হতাশা। শিকারেও কোনো আনন্দ পাচ্ছিলেন না।

তাঁর বংশের রক্তেই ছিল ‘বাইপোলার মোড ডিসঅর্ডার’ নামের এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। এই রোগের দুটো লক্ষণ একদিকে উচ্ছ্বাস অন্যদিকে ভীষণ বিষণ্ণতা। তার বাবা, ভাই ও এক বোন আত্মহত্যা করেছিলেন। শেষ দিনগুলোতে হেমিংওয়ের আচরণ তার বাবার শেষ দিনগুলোর আচরণের মতো হয়ে গিয়েছিল।

২ জুলাই সকালে প্রিয় বন্দুক নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে দিলেন শেষমেশ! বিদায় পৃথিবী, বিদায় এই জগতের সাহিত্য। পাপা হেমিংওয়ে ঢলে পড়লেন সকল বিষণ্ণতার ঊর্ধ্বে।

অবশ্য তার স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে অবশ্য বলেছিলেন ‘হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেননি। হয়তো ভোরে শিকারে যাওয়ার আগে বন্দুক সাফ করার সময়ে আচমকা অসাবধানতাবশত গুলি বের হয়ে তার মাথায় লাগে।’

১৯৬১ সালের আজকের দিনেই চলে গিয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তার প্রতি।

আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে ১৮৯৯ সালের আজকের দিনে (২১ জুলাই) আমেরিকার ইলিনয়ের ওক পার্কে জন্মগ্রহণ করেন।

More from BooksMore posts in Books »
More from InternationalMore posts in International »
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *