Press "Enter" to skip to content

হয়ে যেতে পারতেন কট্টর স্বদেশী, হয়ে গেলেন ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! বুকের আড়ালে নিষিদ্ধ বই, টিফিন বক্সে রিভলভার…

Spread the love

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবলু ভট্টাচার্য : হয়ে যেতে পারতেন কট্টর স্বদেশী। হতে পারতেন পার্টির হোলটাইমার, হয়ে গেলেন ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়! আট-দশ বছর বয়েস থেকে ‘গুরু’ বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। তাঁরই সাইকেলে চেপে ঘুরতেন। বুকের আড়ালে নিষিদ্ধ বই, টিফিন বক্সে রিভলভার। চলত পাচার করা। দীনেশ গুপ্ত মারা যাওয়ার পর জড়িয়ে পড়েন ঢাকায় ‘অনুশীলন সমিতি’র কাজে। ’৪১ সালে, যখন বিএ পড়ছেন, কোনও এক ব্রিটিশ ইনফর্মার খুন হল অনুশীলন সমিতির হাতে। সে দলের পাণ্ডা ছিলেন উনি। ফলে হুলিয়া জারি। পালিয়ে যেতে হল পুব বাংলা ছেড়ে। ততদিনে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপক বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর প্রিয়পাত্র। রমেশ মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিনের প্রিয় ছাত্র। ক্লাসের বাইরে সত্যেন বসুর আবদারে তাঁকে প্রায়ই ঢাকাই কুট্টিদের নিয়ে কমিক শোনাতে বসেন।

বলতেন— ছিলাম ‘বাঁড়ুজ্জে’, হয়ে গেলাম ‘ভাঁড়ুজ্জে’! বিক্রমপুরের বিখ্যাত মাস্টার জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকার নবাব এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতিদেবী। সরকারি শিক্ষা বিভাগের চাকুরে। তাঁরও নামজাদা বংশ। সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া। তাঁদেরই ছেলে সাম্যময়। ডাকনাম ভানু। তার মঞ্চে নামাটা কিন্তু এক্কেবারেই আকস্মিক। পাড়ার নাটক দেখছিল ছোট্ট ভানু। স্টেজের নীচে দাঁড়িয়ে। ওপর থেকে কোনও এক খুদে অভিনেতা দুষ্টুমি করে লাথি কষায় মাথায়— ‘হালায় ওই লাথখা’ন কুনওদিন ভুলি নাই, ওই দিনই ঠিক কইরা ছিলাম, অগো দ্যাখাইয়া ছাড়ুম।’ ওয়াড়ি ক্লাবের ‘বনবীর’ নাটকে সুযোগ এসে গেল। তখন সবে ক্লাস সিক্স। উদয়সিংহ হলেন ভানু। তাঁর অভিনয়ে চমকে গেল সবাই। কলকাতায় এসেও পাড়ার নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’য় চাণক্য হলেন। সে অভিনয় এতই সাড়া ফেলল যে পল্লিরই এক ডাক্তার তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখনকার নামকরা পরিচালক সুশীল মজুমদারের দরবারে।

ছবি বিশ্বাস ছিলেন ভানুবাবুর গুরু। আর সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন জহর রায়। ১৯৫৫ সালে অস্টিন গাড়ি কিনলেন ভানুবাবু। কিনে সোজা স্টুডিওতে। সভা করে ফেললেন জহরবাবু। এই প্রথম একজন কমেডিয়ান গাড়ি কিনেছে— অতএব উৎসব হল স্টুডিওতেই। প্রত্যেক শনিবার জহর রায় গাড়ি নিয়ে যেতেন। আর ভানুবাবু স্টুডিওতে যেতেন ভাড়া-ট্যাক্সি করে। কারণ জহর রায় মনে করতেন, এটা কমেডিয়ানকুলের গাড়ি, ভানুদার একার নয়। পাত্র ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ইণ্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল’-এ সামান্য বেতনের চাকরি করেন। ঢাকা থেকে কলকাতায় পা দিয়ে ১৯৪১ থেকে চাকরি করছেন। ১৯৪৬-এ দাঙ্গার শুরু। ২৩ ফেব্রুয়ারি, কলকাতায় সেদিন সব বন্ধ। দোকানপাট, যানবাহন— সব কিছু। এর মধ্যেই টালিগঞ্জ পাড়ায় বর-কনের শুভদৃষ্টি, সাত পাক ঘোরা, ফুলশয্যা— কী করে সম্ভব হল? খুব সোজা। দুই বাড়ির মধ্যে দূরত্ব বিশেষ ছিল না। কাছাকাছি পাড়াতেই থাকতেন তাঁরা। তাই বর টোপর মাথায় হাঁটতে হাঁটতেই চলে এল।

বাড়িতেও বাঙাল কথায় মজা করতেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুব মজা করতেন। আবার, ওরা ওঁকে ভয়ও পেত। মেয়ে বাসবী, তপন সিংহের ‘অতিথি’-তে কাজ করেছিল। তারপর কত অফার। তিনি কাজ করতে দেননি। পড়াশোনা আগে। ছেলেমেয়েদের সিনেমায় নিয়ে আসার পক্ষে ছিলেন না কখনও।১৯৪৬ সালে বিয়ের তেরো দিনের মধ্যে ইণ্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল-এ চাকরি করতে করতেই তিনি সিনেমায় অভিনয় করাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পরিচালক সুশীল মজুমদারের সহকারী ভূজঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে পড়ে গেলেন ভানু বাবু। শ্বশুরবাড়িতে দ্বিরাগমনে এসেছেন তিনি। ওখান থেকেই সোজা স্টুডিও ফ্লোরে। ছবির নাম ‘জাগরণ’। পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তী। এই ছবিতেই প্রথম সুর দেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। তিনশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।

‘সুচিত্রা-উত্তম’ জুটি যখন দাপটের সঙ্গে টলিউড শাসন করে চলেছে, ঠিক সেই সময়েই ‘ভানু-জহর’ জুটির কিংবা ছবিতে কমেডিয়ানদের দাপটও কিন্তু কম ছিল না। ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবিতে সুচিত্রা সেন তখন দৈনিক ১৫০০ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একই ছবিতে কাজ করেছেন দৈনিক ১০০০ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে।ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ফিল্মে তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন দৈনিক ২৫০ টাকায়। এসব নিয়ে বহু পরিচালক বা প্রযোজকের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন। বলতেন— ‘নায়ক-নায়িকাই শিল্পী? ওরাই কেবল চরিত্র সৃষ্টি করে। পার্শ্ব চরিত্রে যারা কাজ করে, তারা সব গরু-গাধা। তাদের অবদান কোন অংশে কম?’

কমিটেড এই শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের জন্য অনেক কিছু করে মানুষের কাছ থেকেই কম আঘাত পাননি। নীলিমা যখন তাঁকে বলতেন— ‘তুমি কেন সবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ো, তোমার কথা তো কেউ চিন্তা করে না’, তখন তাঁর উত্তর— ‘আমি এরকমই করব। আমার স্বভাবই এটা। জান না স্বভাব যায় না মলে?’

এনলার্জড লিভার। রেনাল ফেলিওর। থাইরয়েড— সব মিলিয়ে নাজেহাল হাসির রাজা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ভানু ব্যানার্জি ১৯২০ সালের আজকের দিনে (২৭ অগাস্ট) বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.