Press "Enter" to skip to content

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমার মাধ্যমে….।

Spread the love

প্রবীর রায় : চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা।কলকাতা, ১৭ জুন, ২০২৪। চির বসন্তে হেমন্ত:-
আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে
পান্থ পাখির কুজন কাকলী ঘিরে
আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো
আমি যদি আর না’ই আসি হেথা ফিরে…। তবু……।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামটি মনে হলেই বাঙালীমাত্রই এক সুরেলা জগতে প্রবেশ করে। সেই সাথে কালো ফ্রেমের চশমা আর ফিল্মের হিরোর মত একটি কোমল চেহারাও ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

৫০/৬০/৭০-এর দশককে আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় আধুনিক গানের প্রবাদ পুরুষ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কত বড় গায়ক ছিলেন কিংবা সুরকার সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি যে বাঙালীর আবেগ সে কথাও নতুন করে বলতে হয় না। তাঁর গান আজও প্রায় প্রতিটি বাঙালী বাড়িতে বাজে। তাঁর গান ভেসে এলেই মনে হয়, পৃথিবীর যত প্রেম যেন জমা হয়েছে তাঁর গলাতেই। যে কণ্ঠে প্রেম আর বিরহের স্বচ্ছন্দ সহবাস।

অসাধারণ সুরসৃষ্টি আর স্নিগ্ধ ও মোহময় কণ্ঠের ছোঁয়ায় তিনি সঙ্গীতভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, হয়ে উঠেছেন সঙ্গীতের বরপুত্র। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গান আজও আমাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখে। তাঁর গান মানেই ক্লান্তির ঘোর কাটা প্রশান্তি, এক চিলতে সুখের অনুভব।

অথচ এই মানুষটাকেও এক সময় রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়েও ঠায় চার ঘণ্টা বসে থেকে শুনেছেন, ‘দূর মশাই, আপনার গান কে শুনবে? দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন! ওঁর গান শুনে বাড়ি চলে যান।’

এক সময় ভেবেছিলেন, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন। গল্প লিখতেন। তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হওয়া হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকে পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে হয়েছিলেন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। চার ছেলে, এক মেয়ের দ্বিতীয় হেমন্তকে নিয়ে ছোট থেকেই বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক আশা। চৌদ্দ পুরুষের ভিটে বড়ুগ্রাম ছেড়ে কালিদাস পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন ভবানীপুরের ২৬/২এ রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। দু’ঘরের বাড়ি। ম্যাকনিন ম্যাকেনজির সাধারণ কেরানি কালিদাস। বাবা চাইলেও ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হয়নি তাঁর।

ততোদিনে বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় অসিতবরণকে ধরে রেডিওতে অডিশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। অভিনেতা অসিতবরণ তখন রেডিওতে তবলা বাজান। অডিশনে পাশ করার তিন মাস পর প্রোগ্রামের চিঠি এল। গান শুনে পাহাড়ী সান্যাল বললেন, ‘বাহ্, চর্চা করলে ভাল গাইয়ে হবে।’ পঙ্কজ মল্লিক এক দিন আকাশবাণীতে অনুজ হেমন্তকে দেখে বললেন, ‘তুমি তো দেখছি আমাদের ভাত মারবে!’

১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেটাকে কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে চেনাজানা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

শেষে ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করলেন সঙ্গীত জগতে। এই বছর তিনি নরেশ ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানী কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে গান গাইবার জন্য ইডেন গার্ডেনের স্টুডিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ ইন্ডিয়া’র জন্য গান রেকর্ড করেছেন।

১৯৪১ সালে এই শিল্পী তাঁর প্লে-ব্যাক সংগীত জীবন শুরু করেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির মাধ্যমে। এরপর থেকেই তিনি ভারতীয় বাংলা সিনেমার একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। ফলে দর্শক-শ্রোতা একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান উপহার পেয়েছেন। ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করে হিন্দী গানের শ্রোতাদেরকেও নিজের জাত চিনিয়েছিলেন হেমন্ত।

একই বছরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম নিজের কম্পোজিশনে দুটো গান করেন। গান দুটির গীতিকার ছিলেন অমিয় বাগচী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন ‘পথের শেষ কোথায়’।

সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমার মাধ্যমে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত নিজেকে সম্ভাবনাময় শিল্পী এবং কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। সেসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ কণ্ঠশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছিলেন।

১৯৫৪ সালে বলিউডি সিনেমা ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই ছবির গান সেসময় দুই বছর ধরে টপচার্টের শীর্ষে অবস্থান করেছিল এবং এই সিনেমার জন্যই হেমন্ত ১৯৫৫ সালে ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর’ এর পুরস্কার লাভ করেন।

এরপর তিনি বাংলা সিনেমা ‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের জন্য চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা। সলিল চৌধুরীর সাথে তাঁর জুটি বাংলা গানের ইতিহাসে আরেকটি অসামান্য অধ্যায়।

আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গায়ক,সুরকার বা ‌ সঙ্গীত পরিচালক ভাবলে কিছুই বলা হয় না। তিনি ঈশ্বরের এক অবিনশ্বর সৃষ্টি। কালজয়ী এই সঙ্গীতব্যক্তিত্ব আপামর মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে আছেন। কালের নিয়মে তাঁর যাদুকন্ঠ থেমে গেছে ১৯৮৯ সালে। হেমন্ত কন্ঠের গভীর রসায়ন আজও শেষ হয়নি শ্রোতাদের কাছে। আজও এই ধূসর সময়ে তাঁর কন্ঠের ইন্দ্রজাল আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। আগামী পৃথিবী অনন্তকাল কান পেতে শুনবে প্রশান্তির আবাহন ছড়ানো সেই কণ্ঠের কারুকাজ।

(সূত্র কৃতজ্ঞতা – আন্তর্জাল)

প্রচ্ছদ চিত্র- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিতে মাল্যদানের পর দেবাশীষ কুমার, শিবাজী চট্টোপাধ্যায় সহ বিশিষ্টরা।

More from EntertainmentMore posts in Entertainment »
More from InternationalMore posts in International »
More from MusicMore posts in Music »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.