আত্মকথায় :::—
প্রবীর রায় : অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। ২৯ নভেম্বর ২০২১। তখন আমি ক্লাস টেনে। সেই সময় শীতকালে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় তখন সারারাত জলসা হতো। পাড়ার উঠতি ছেলে মেয়েদের সুযোগ করে দেওয়া আর কি! আমরা ক’জন ছিলাম উদ্যোক্তা।
আমরা একটু চ্যাংড়া টাইপের। আমাদের কাছে হিন্দি কপি সিঙ্গারের কদর ছিল বেশি। পাড়ার শিল্পীদের নাচ – গান – আবৃত্তি সব রাত ন ‘ টার মধ্যে হুড়োহুড়ি করে শেষ করে দিতাম। পরে শুরু হত আমাদের পছন্দের শিল্পীদের অনুষ্ঠান। চলতো ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। এটা ছিল আমাদের এক বাৎসরিক ফুর্তি।
সেই বছরে পাড়ার সিনিয়ারদের অনুরোধে, মিটিংয়ে ঠিক হল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করতে হবে । সকলে রাজি হলাম বাধ্য হয়ে। যদি ভবিৎসতে বন্ধ হয়ে যায় আমাদের জলসা। কদিনের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে যার দ্বায়িত্বে নিয়ে । কেউ পোস্টার আঁকছি।কেউ স্টেজের দেখাশোনা। কেউ থানা ও কর্পোরেশনে ছুটছে । হৈ হৈ করে চাঁদা তোলা হচ্ছে বাড়ি বাড়ি ঘুরে।সেই বছর আমাদের চাঁদা তোলার জন্য একটুও কষ্ট পেতে হয়নি। বিশেষ করে মা – কাকিমা – মাসিমাদের উৎসাহ ছিল বেশি। ওরা নিজেরাও অনেক ডোনেশন জোগাড় করে দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। আমরা ক’জন সেদিন শিখেছিলাম সবাইকে নিয়ে চলার কি ভীষন আনন্দ!
আমার ডিউটি পড়ল কিংবদন্তি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে আসা ও বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। কথা ছিল বিকেল পাঁচটায় আমাকে টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান স্টুডিও থেকে সরাসরি ওঁকে পাড়ায় নিয়ে আসার । এখানে চুপি চুপি বলে রাখি , এই ডিউটি পেতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। কারণ এই ডিউটির চাহিদা ছিল তুঙ্গে।
বিকেল চারটের সময় আমি টালিগঞ্জে পৌঁছে গেলাম।গিয়ে দেখি উঁনি একটা গান রেকর্ডিংএ ব্যস্ত। যতদূর মনে আছে গানটি “সাথীহারা” সিনেমার জন্যে গাইছিলেন। একটু দেরি হয়ে গেল আমাদের রওনা হতে। ওঁনার অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে করে, পাড়ায় পৌঁছলাম আটটার সময়ে। পাড়ায় ঢুকতেই হৈ চৈ পড়ে গেলো। আমিই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে পথ দেখিয়ে গ্রীন রুমে নিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ্য করলাম, ওঁনার সঙ্গে আমাকে ও সকলে বেশ সমীহ চোখে দেখছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আলোয় আমিও আলোকিত। এমন কি পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরাও আমার সঙ্গে বেশ মৃদু স্বরে ও মিষ্টি ভাষায় কথা বলছেন। আসলে তৎকালীন সময়ে আমাদের উত্তর কলকাতার সেই এঁদো গলিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আগমন ছিল কল্পনাতীত।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যাবতীয় কথাবার্তা সব আমার মাধ্যমেই চলতে থাকল। এমনকি উঁনিও আমাকেই সরাসরি সব কিছু জানাতে থাকেন। আমার মনে তখন বেশ একটা জামার কলার উঁচিয়ে হাঁটার মতন অহঙ্কারী ভাব!
আমি মাতব্বরি মেরে সেক্রেটারিকে বললাম , উঁনি বেশি দেরি করতে পারবেন না। এখুনি স্টেজ চাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিশু দৌড়ে গেল। স্টেজে তখন আমাদের পাড়ার মিঠু। সে রবীন্দ্র নৃত্য করছিল। লাল নীল আলোতে উদ্ভাসিত হচ্ছিল ওর নৃত্যভঙ্গিমা। বিশু এক ধমকে ওকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিল। পরিস্কার মনে আছে, মিঠু কিন্তু একটুও অভিমান করেনি এইজন্যে। বরং জিভ কেটে মাঝ শোতে নেমে গেল স্টেজ থেকে। এ ঘটনার লজ্জায়, আজ আমার চোখে জল এনে দেয়। এতটা বাড়াবাড়ি আমি না করলেই পারতাম।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মঞ্চে উঠলেন। সঙ্গে চারজন মিউজিশিয়ান। আর এক কোণে বসে আছি আমি।শিল্পীর তদারকি করতে। গান শুরু হল।
আমাদের পাড়ায় একটা বড় ছাপাখানা ছিল। রাত দশটা পর্যন্ত ওদের দুটো ক্রেডেল মেশিন চলত ঘটাং ঘটাং শব্দ করে। শনি রবি প্রতিদিন। ওরা আমাদের অনেক টাকা চাঁদা দেন। তাই আমাদের কিছুই বলার ছিল না ওদের।খেয়াল করে দেখি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুরু হতেই, ছাপাখানার মেশিন দুটো সেদিন বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। পুরো পাড়াটা নিস্তব্ধ। কে যেন শুধু মঞ্চের আলো বাদে, সব আলো নিভিয়ে দিল তখন। শুরু করলেন প্রথম গান “মোর বীনা উঠে কোন সুরে বাজে” ! ওঁর ওই ভরাট কণ্ঠস্বরের জাদুতে যেন এক মুহুর্তে আমাদের এঁদো গলি সুরের আকাশে পৌঁছে গেল। সে এক স্বপ্নময় পরিবেশ। এমনকি বিশু যে শুধু শাম্মী কাপুরের একনিষ্ঠ ভক্ত। সারাদিন অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস গাইতে থাকে। সেও অন্ধকারে চুপিচুপি স্টেজের কোণে, আমার পাশে এসে বসলো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বিভোর হয়ে শুনতে লাগলো হেমন্তের গান। সেদিন আমি উপলব্ধি করেছি,’ কি জাদু বাংলা গানে’ । যাঁর কণ্ঠস্বর এতো মর্মস্পর্শী, তিনি মানুষ নন স্বয়ং ঈশ্বর।
ওঁর গান থামলো রাত দশটায়। ওঁর ফেরার পালা। আমি ওঁর সন্মানিক অর্থের খাম দিলাম। আমাদের সেক্রেটারি আমাকে ওঁর ড্রাইভার ও মিউজিশিয়ান সমেত মোট সাতটা মিষ্টির বাক্সো দিলেন। ওদের দেওয়ার জন্যে। ওঁরা সকলেই বললেন গাড়িতে নিয়ে নাও। আমি একটা ব্যাগে মিষ্টির বাক্সো ভরে গাড়িতে উঠে সকলকে দিতে লাগলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলে উঠলেন , ওই গুলো এখন কারুকে দিতে হবে না। তোমার কাছে রাখো। পথে একেক জন মিউজিশিয়ান নেমে যেতে থাকেন। আমি মিষ্টির বাক্সো এগিয়ে দিতে গেলে ওরা সবাই নিতে অসম্মত হন। সব শেষে গাড়ি সাউদার্ন এভিনিউতে এলো। সামনেই ওঁর বাড়ি। উঁনি আমার কাছে এসে বললেন মিষ্টির বাক্সো গুলো দাও। আমার একটু অদ্ভুত লাগলো। এত বিখ্যাত মানুষ উনি, এই সামান্য মিষ্টির বাক্সো সব গুলো একাই বাড়ি নিয়ে যাবেন। যাকগে, আমি ব্যাগ খুলে মিষ্টির বাক্সো বের করতে থাকি। তাকিয়ে দেখি গাড়িতে ওঁর ড্রাইভার নেই । উঁনিও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। একটু পরেই দেখি ফুটপাতের ঝুপড়ি থেকে চারজন বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছুটে এলো ড্রাইভারের কাছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে আমি প্রত্যেক বাচ্চাগুলোকে মিষ্টির বাক্সো তুলে দিলাম। এবার হেমন্ত বাবু আমায় হাত নেড়ে বাড়িতে ঢুকে গেলেন।
ফেরার পথে, ড্রাইভারের কাছেই শুনলাম কোনও অনুষ্ঠান থেকে ফিরলে ওই পথের শিশু গুলি বসে থাকে ওঁর জন্যে। মিষ্টির বাক্স র অপেক্ষায়। আমি তখন ভাবতে থাকি,ওঁর কণ্ঠের চেয়ে , ওঁর হৃদয়ের স্বর আরও বেশি ঈশ্বরের।
Be First to Comment