Press "Enter" to skip to content

হিন্দুদের সপ্তপুরী হলো – কাশী, কাঞ্চি, মায়া,( হরিদ্বার) , অযোধ্যা , দ্বারাবতী ,মথুরা ও অবন্তিকা…..৷

Spread the love

“হরিদ্বার ,গঙ্গা ও গঙ্গারতি !”
————————————-
ডাঃ দীপালোক বন্দ্যোপাধ্যায় : ২৩ অক্টোবর ২০২১।  আমাদের হিন্দুদের সপ্তপুরী হলো – কাশী , কাঞ্চি, মায়া ( হরিদ্বার) , অযোধ্যা , দ্বারাবতী ,মথুরা ও অবন্তিকা ৷ দক্ষরাজ কন্যা সতী বা মহামায়া এখানে জন্মগ্রহন করেছিলেন বলে হরিদ্বার , কনখল ও হৃষিকেশ হলো ” মায়াপুরী ” ৷ বৈষ্ণব মতে শ্রীহরির দর্শন পাওয়ার প্রথম দরজা “হরিদ্বার” বা “হরিকি পৌড়ি” ৷ এখানে আছে পালনকর্তা বিষ্ণুর পায়ের ছাপ ৷ এখানে বিষ্ণুর বাহন গরুড় অমৃত কলসী নিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা অমৃত পড়েছিল বলে হয় কুম্ভমেলা ৷ আবার এখান থেকে উঁচুতে কেদারনাথে যেতে হয় বলে শৈব মতে এটা ” হরদ্বার “বা ” হরকি প্যার ” ৷  ঈশ্বরের দরজা ৷ রাজা শ্বেত যেখানে যজ্ঞ করেছিলেন , সেখানে উপাসনায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা আবির্ভূত হন ৷ সেই যজ্ঞকুন্ডটির নাম হয় ব্রহ্মকুন্ড ৷ বৈদিক যুগে শিব ও বিষ্ণু হর কি পৌড়ির ব্রহ্মকুন্ড দর্শন করেছিলেন ৷ এখানে যুগ যুগ ধরে গঙ্গা পূজা ও আরতি হয় ৷ এখানেই গঙ্গা পার্বত্য অঞ্চল ছেড়ে সমতলে প্রবেশ করেছে ৷ আধ্যাত্মিক ভাবে হরিদ্বারের ঘাটের গুরুত্ব কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটের সমতুল্য ৷ ব্রহ্মকুন্ডে স্নান করে আমরা করি ভগবানের শ্রী পাদপদ্ম দর্শন ৷ দেবতারা এখানে বিরাজ করেন ৷ সাধু সন্ন্যাসীরা করেন সাধন ভজন ৷ হরিদ্বারের আরেক নাম          “গঙ্গা দ্বার”৷

উত্তরাখন্ড রাজ্যকে বলা হয় দেবভূমি ৷ “আরতি” হলো আলো দেখিয়ে বা প্রশংসায় গান গেয়ে দেবদেবীর আরাধনা ৷ হিন্দুদের পবিত্রতম জলাশয় “গঙ্গা” ৷ গঙ্গা হলেন হিমালয় ও মেনকার কন্যা এবং পার্বতীর বোন ৷ বৈষ্ণবরা বলেন ব্রহ্মা কমন্ডলুর জল দিয়ে বিষ্ণুর পা ধোওয়ার সময় গঙ্গা অবতীর্ণ হন ৷ আরেক পুরাণ মতে নারদের অনুরোধে শিবের গান শুনে বিষ্ণু আংশিক দ্রবীভূত হলে ব্রহ্মা তা কমন্ডলুতে ধারন করেন ৷ এই দ্রবীভূত অংশই গঙ্গা ৷ তাই গঙ্গার আরেক নাম অঙ্ঘ্রিজা ৷ সগর রাজার মৃত পুত্রদের আত্মার মুক্তিকামনায় সগরের বংশধর দিলীপের ছেলে ভগীরথের তপস্যা বলে মা গঙ্গা মর্ত্যে আসেন ৷ শিবের মাথার জটা হয়ে স্বর্গের নদী গঙ্গা পাতালে প্রবাহিত হওয়ার আগে মর্ত্যলোকের জীবদের মুক্তির জন্য প্রবাহিত হন ৷ স্বর্গ , মর্ত্য ও পাতাল তিন লোকের নদী বলে নাম হয় “ত্রিপথগা” ৷ ভগীরথ এনেছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম “ভাগীরথী” ৷ আবার মর্ত্যে আসার সময় জহ্নু মুনির আশ্রম প্লাবিত করেছিলেন বলে ঐ মুনি রাগে সম্পুর্ণ গঙ্গাকে পান করে ফেলেন ৷ পরে ভগীরথের অনুরোধে নিজের জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেন ৷ তাই জহ্নু মুনির মেয়ে বলে পরিচিতা হন ৷ আর নাম হয় জাহ্নবী ৷ স্কন্দ পুরাণ মতে শিব -দুর্গার ছেলে কার্তিকের পালিকা মা হলেন গঙ্গা ৷ আবার পার্বতীর গাত্রমল থেকে উৎপন্ন গণেশের মূর্তি গঙ্গার জলে দিলে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ এজন্য গণেশকে বলা হয় দ্বৈমাতুর।

অর্থাৎ দুই জননী দুর্গা ও গঙ্গা ৷ তাই আরেক নাম গাঙ্গেয়।  ব্রহ্মবৈর্বত পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর তিন স্ত্রীর অন্যতমা গঙ্গা ৷ পরস্পর কলহ হলে বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিজের কাছে রেখে শিবকে গঙ্গা ও সরস্বতীকে ব্রহ্মাকে দান করেন ৷ গঙ্গা ও সরস্বতী একে অপরকে মর্ত্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার অভিশাপ দেন ৷এরফলে গঙ্গা ও সরস্বতী নদী হয়ে মর্ত্যে পতিত হন ৷ আবার মহাভারতে ভীষ্ম গঙ্গা ও শান্তনুর অষ্টম পুত্র ৷ দেবী হিসাবে গঙ্গার যে মূর্তি রয়েছে সেখানে বরুণের মত গঙ্গারও বাহন মকর( দেহাংশ কুমীর ও লেজ মাছের , জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্যাপ্রিকন ) ৷

হরিদ্বারের প্রধান আকর্ষন গঙ্গাস্তুতি ৷ “দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে ত্রিভূবন তারিণী তরল তরঙ্গে / শঙ্কর মৌলী নিবাসিনী গঙ্গে মম গতি আস্থাম তব পদ কমলে “৷ কাশীর মতো রোজ সন্ধ্যায় এখানে হয় গঙ্গারতি ৷ কাশী ও হৃষিকেশের চেয়ে এখানকার আরতি আমার বেশী আকষর্নীয় মনে হয়েছে ৷আরতি শুরুর আগে জায়গা নিতে হয় ৷ নচেৎ ভীড়ে দেখা কঠিন ৷ আরতি শুরুর পর হাজারো ঘন্টার ধ্বনি ও মন্ত্রের গাম্ভীর্য মনে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে ৷

লছমন ঝুলার পাশে গঙ্গা আরতি।

লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থীর জলে ভাসানো প্রদীপ স্রোতের টানে ছুটে চলে ৷দেখে মনে হয় আকাশের তারারা গঙ্গায় এসে মিশেছে ৷পশ্চিমবঙ্গে হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাট বা চিন্তামণি দে ঘাটে , নবদ্বীপেও গঙ্গা আরতি দেখেছি ৷মথুরার বিশ্রাম ঘাটে হয় যমুনা আরতি ৷হরিদ্বারের গঙ্গামাতার মন্দির , শঙ্করাচার্য ও বাল্মীকী মন্দির ক্লক টাওয়ারের কাছে ” গঙ্গা মাতা কি জয়” ধ্বনির মধ্যে হতে থাকে গঙ্গারতি ৷ এখানে গঙ্গার প্রবাহেরও বদল হয়েছে ৷ শহরের উত্তরে ভীমগোদায় বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে কৃত্রিম স্রোত ৷ পশ্চিম ঘাটে রূপোর সিংহাসনারূঢ় গঙ্গামাতার মূর্তির পাশে প্রধান পুরোহিত সহ সাদা ধুতি চাদর গায়ে পূজারীরা সারিবদ্ধভাবে ঘন্টা বাজিয়ে মন্ত্রোচারণ করে মা গঙ্গার আরতি করে ৷ গঙ্গাস্নানের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হরিদ্ধার , প্রয়াগ ( এলাহাবাদ) ও গঙ্গাসাগর ৷ ৫১ পীঠের অন্যতম সতীপীঠ হরিদ্বার ৷

এখানে সতীর জঠর আবার কোন মতে নাভি পড়েছিল ৷ এখানে দেবী সিংহবাহিনী মায়াদেবী ” ভৈরবী” ৷ ভৈরব শিব হলেন “বক্র” ৷
পুরাকালের গঙ্গাদ্বার আজকের ” হরিদ্বার ” ! কপিল মুনির আশ্রম ছিল বলে কপিলা বলেও খ্যাত ছিল ৷ উত্তরবাহিনী পবিত্র গঙ্গার তীরে ছিল ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম ৷ হোমের আগুনে পুড়ে এখানে কুন্তী ও গান্ধারীর মৃত্যু হয় ৷ মহাভারতের বাণপ্রস্থ আশ্রম ছিল এই হরিদ্বারেই ৷

বিখ্যাত এই হিন্দুতীর্থের বিস্তারিত বিবরণ আছে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের লেখায় , মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘ তুজুক ই জাহাঙ্গীরী ‘তে আর সুপ্রাচীন কাল থেকে আমাদের নানা ধর্মগ্রন্থে ৷ নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থে লেখা আছে এখানকার “কুম্ভমেলা ” সুবিখ্যাত ৷
তেমনি মনে রাখার মত এখানকার হরকী পাউরী ঘাটে প্রাত্যহিক “গঙ্গা আরতি ” !যা রোজ সন্ধ্যায় এখানকার প্রধান আকর্ষণ ৷কালিদাস লিখেছেন, ” নমাস্তহস্তু গঙ্গে তদঙ্গ প্রসঙ্গাদ্
ভুজঙ্গস্তু রঙ্গাঃ কুরঙ্গাঃ প্লবঙ্গাঃ ৷
অনঙ্গারিরঙ্গাঃ সসঙ্গা শিবাঙ্গা
ভুজগঙ্গাধিপাঙ্গী কৃতাঙ্গা ভবন্তি ৷”
“পরা পবিত্রা পূণ্যাখ্যা পাবণী পীতবাসিনী
পতিতোদ্ধারিণী ত্রিভূবন ধন্যা “গঙ্গাকে প্রণাম “!
জয় গঙ্গা মাঈয়া ৷ প্রণাম হরিদ্বার ৷

More from InternationalMore posts in International »
More from SocialMore posts in Social »
More from TravelMore posts in Travel »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.