প্রবীর রায় : বিশিষ্ট অভিনেতা, প্রযোজক ও চিত্র পরিচালক। কলকাতা, ১৩, সেপ্টেম্বর, ২০২০। “হারানো সুরের” পর আরো একটা দূরদর্শন Commissioned প্রোগ্রাম করেছিলাম সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ৪ টা গল্প নিয়ে “অন্য গল্প” নামে । দুটো গল্পের নাম মনে আছে “বন্ধের দশ দিন ” আর “সাপের চোখের ভিতর দিয়ে” ।
এর পর আরো অনেক সিরিয়াল করি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রফুল্ল রায়ের “আমার নাম বকুল”, “জাতক কন্যা”, “ “নৃত্যের তালে তালে” “মানিক” । ‘জাতক কন্যা” তে তখনকার বাংলার সব নায়িকা একেকটা পর্বে অভিনয় করেছিলেন একেক জন ‘কন্যা’ হিসেবে।
“মানিক” মেগা সিরিয়াল নিয়ে অনেকে ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো । দূরদর্শনের নিলামে “মানিক” এর স্লটটা আমি পাই…কিন্তু আমাকে না দিয়ে স্লটটা অন্য এক প্রোডিউসারকে দিয়ে দেওয়া হয় বিশেষ কোনো অজানা কারণে। তখন অবশ্য আমার প্রপোসাল “মানিক” ছিল না । আমার প্রপোসাল ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দুর্গেশনন্দিনী” ! সেই সময় কলকাতা দূরদর্শনের এক বিরাট প্রোডিউসার আমাকে বললেন, আপনি আমাদের সঙ্গে jointly করুন। আমরা কেস করে স্লট বার করে আনবো। আমি রাজি হয়ে গেলাম । হাইকোর্ট এ কেস উঠলো । কেস চলছে, আমি এক সময় খবর পেলাম, কেস এমন ভাবে চলছে যে আমি স্লট তো পাবোই না, উল্টে আমার ফেঁসে যাওয়ার চান্স আছে। পুরো স্লটই সেই প্রোডিউসারের কাছেই চলে যাবে। সেই প্রোডিউসার আমার একটা চিঠির ডেটও পাল্টে দিয়েছিলেন। আমি তো শুনেই কোর্টে নিজে হাজির হয়ে গেলাম। এখনো মনে আছে Honorable জাস্টিস আনসারীর বেঞ্চে কেসটা ছিল। আমি কোর্টে গিয়ে আমার কাউন্সিলকে বলছি, আমি কেস উইথড্র করতে চাই কিন্তু উনি আমার কথার কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না। মানে all are purchased !! আমি বাধ্য হয়ে সরাসরি জজ সাহেব কে বললাম “Your honour, I want to withdraw this case” । Honourable Judge বললেন “where is your counsel”? তারপর উনি আমার কাউন্সেলকে জিজ্ঞেস করলেন, “Why you are not co-operating your client “? তারপর আমাকে বললেন “বলুন আপনি কি বলতে চান “। আমি বললাম যে আমি কেস উইথড্র করতে চাই, উনি নিজে পুরো শুনলেন, ওনার স্টেনো সব লিপিবদ্ধ করলেন ।
ব্যাস , আমি বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেলো আমাকে থ্রেট করা । বাড়িতে লোক চলে এলো আমার স্ত্রী আর ছেলেকে বলে গেলো প্রবীর রায় কে বলুন immediately সেই প্রোডিউসারকে meet করতে , otherwise এটা খুব খারাপ দিকে টার্ন নেবে, আমার গাড়ি রাস্তায় উড়িয়ে দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি আমার স্ত্রীকে বললাম , চিন্তা করো না, আমি আসছি বাড়িতে। আমি “খোঁজ খবর” কে জানালাম….ওঁরা ওদের পুরো team বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।
তারপর আমাকে বললেন আপনি ওনাকে ফোন করুন। আমি সেই প্রোডিউসারকে কে ফোন করলাম । “খোঁজ খবর” টীম পুরো ওনার ভয়েস , আমার কথা বলা সব ভিডিও রেকর্ড করে, সেইদিন রাত্রেই টেলিকাস্ট করলো। হৈ চৈ পড়ে গেলো চারিদিকে ।
সে এক রোমহর্ষক ঘটনা। সে যা গেছে তখন, শুধু আমি জানি । ওই প্রোডিউসারের বিরুদ্ধে তখন কথা বলার সাহস করো ছিল না। আমি তখন মোটামুটি হিরো হয়ে গেলাম । “খোঁজ খবর” এর সেই DVD এখনো আমার কাছে আছে ।
যাক এবার মূল ঘটনায় ফিরি ! দূরদর্শন তখন ঠিক করলো চ্যানেল ২ শুরু করবে । তখন কিন্তু দূরদর্শন ছিল Terrestrial মানে Direct to home (DTH)। মানে without cable । কিন্তু দূরদর্শন- ২ মানে Through cable, যাদের বাড়িতে Cable থাকবে, তারাই শুধু এই চ্যানেল দেখতে পাবে । তার মানে Viewership অনেক কমে যাবে কারণ তখন গ্রামে গঞ্জে cable প্রায় ছিলই না বললে হয়। কলকাতাতেই অনেক বাড়িতে cable ছিল না । সেইজন্য স্পনসর প্রোগ্রাম করা খুব সমস্যা। Viewership কমের জন্য স্পনসর আগ্রহ দেখাবে না । সেই কারণেই দূরদর্শন ঠিক করলেন ওঁরা Commission প্রোগ্র্যাম দিয়ে ডিডি ২ শুরু করবেন ।
তখন দূরদর্শনের Director General ছিলেন ভাস্কর ঘোষ । ভাস্কর ঘোষ কলকাতা দূরদৰ্শনের কিছু বহিরাগত প্রযোজকদের (Outside producers) নিয়ে একটা মিটিং করলেন কলকাতায়। আমাকে সেই মিটিং এ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ডিডি২ র প্রপোসাল দেওয়ার জন্য। সব অনুষ্ঠানই দিল্লী টাকা দেবে। কলকাতা দূরদর্শনের তৎকালীন ডেপুটি ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম) বিদ্যুৎ সাহা আর প্রোডিউসার সলিল দাসগুপ্ত আমাকে বললেন “প্রবীর, তুমি চিত্রমালার পরিবর্তে যে প্রোগ্র্যামটার কথা বলেছিলে সেটা সাবমিট করো” । ওই মীটিংয়েই “হারানো সুর” অনুমোদন পেলো । ডিডি – ২ র প্রথম কয়েকটা অনুষ্ঠানের মধ্যে “হারানো সুর” অন্যতম । এর পরে অবশ্য আমি আর একটা করেছিলাম ” অন্য গল্প” নামে, যার কথা আগেই বলেছি।
এ তো গেলো Commissioned প্রোগ্র্যাম এর কথা । কিন্তু দূরদর্শনকে তো Sponsored প্রোগ্র্যাম করতে হবে । তা না হলে Revenue আসবে কোথা থেকে ? আমি একটা প্রপোসাল জমা করলাম ডিডি – ২র স্পন্সরড প্রোগ্র্যাম এর জন্য “শব্দ জব্দ” নামে । থ্রিলার। দেবরাজ রায় ডিরেক্টর ছিলেন । প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম আমি আর পাপিয়া । আমার ডাবল রোল ছিল ।
অনুমোদন তো পেলাম । পাইলট এপিসোডও জমা দিয়ে দিলাম কিন্তু স্পনসর !! আমার সিরিয়ালের মার্কেটিং আমি নিজেই করতাম । ২৪০ সেকেন্ডস বোধহয় তখন কমার্শিয়াল টাইম দিতো একেকটা পর্বর জন্য । একেকটা পর্বে যদি কেউ পুরো ২৪০ সেকেন্ডস ব্যবহার করতে না পরে, পরের পর্বে প্রোডিউসার বেঁচে যাওয়া টাইম Use করতে পারতো। কিন্তু যেখানে ২৪০ সেকেন্ডসই পাওয়া যাচ্ছে না , সেখানে বেঁচে যাওয়া টাইম marketing করা অসম্ভব হয়ে পড়তো । একটা কথা জানিয়ে রাখি, আজকাল সিরিয়ালে প্রোডিউসারকে কিন্তু স্পনসর জোগাড় করতে হয় নাইয়। চ্যানেল সেটা নিজেরাই করে । আমাদের সময় কিন্তু সেটা প্রোডিউসারদের করতে হতো । দূরদর্শনে সেই নিয়ম অবশ্য এখনো আছে । Commissioned programme ছাড়া অবশ্য !
“শব্দ জব্দ” অনুমোদন পেয়ে গেলো। কলকাতা দূরদর্শনের ডিডি- ২র প্রথম স্পন্সরড প্রোগ্র্যাম । দূরদর্শনের প্রথম স্পন্সরড প্রোগ্র্যামও আমার প্রোডাকশন ছিল “রবিশঙ্কর – এ লিজেন্ড অফ গ্লোরি” । স্পনসর ছিল “বিজলি গ্রিল” । এই স্পনসর নিয়েও একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো। আমি তখন স্পন্সরের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কারণ তখন দূরদর্শনে স্পনসর প্রোগ্র্যাম বলে কন্সেপ্টই ছিল না । তাই কোনো হাউসই রাজি হচ্ছে না । সেই সময় বিখ্যাত সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত আমাকে বললেন তুমি “বিজলি গ্রিল”- এর মালিক দেবু বারিককে মীট করো, ওনাকে সব বলো। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করলাম , অত্যন্ত সজ্জন ব্যাক্তি । বিজলি সিনেমার পাশের রাস্তায় ওনার অফিসে গিয়ে ওনাকে সব বোঝালাম। পণ্ডিত রবিশঙ্করের অনুষ্ঠান শুনে রাজি হয়ে গেলেন ! তখন পণ্ডিতজি ইন্ডিয়াতে টিভি এপিয়ারেন্স করেননি । সেই প্রথম । দেবু বারিক ভাবলেন, পণ্ডিতজির সঙ্গে “বিজলি গ্রিল” এর নাম জড়িয়ে থাকবে।
সব ঠিক হয় যাওয়ার পর দেবুবাবু আমাকে বললেন আমার কিন্তু বিজ্ঞাপনের ফিল্ম নেই । আমি বললাম “করে দেব”। উনি বললেন আমার কিন্তু দুটো কন্ডিশন আছে। বিজ্ঞাপনটার স্টোরি বোর্ড করতে হবে বিশিষ্ট সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিতকে দিয়ে আর ডাইরেকশন দেবেন গৌতম ঘোষ। আমি বললাম ঠিক আছে। দিব্যেন্দুদা বললেন , স্টোরি বোর্ড কাকে বলে আমি জানি না। আমি বললাম “ঠিক আছে, আপনি কনসেপ্টটা লিখে দিন , স্টোরি বোর্ড বানিয়ে নেবো। “গৌতম আমার বন্ধু ছিল, ও রাজি হয়ে গেল । বাচ্চাদের নিয়ে পুরো শুট করলাম দিব্যেন্দুদার গড়িয়াহাটে “মেঘমল্লার” এর ফ্ল্যাটে। শুট তো হয় গেলো । তখন কিন্তু কলকাতায় কোনো ভিডিও ষ্টুডিও ছিল না। বোম্বেতে একমাত্র ষ্টুডিও ছিল “Western Outdoor” এ । গৌতমের তখন “পার” ফিল্মের প্রিন্ট বেরোচ্ছে মাদ্রাজে। আমি কলকাতা থেকে গেলাম। গৌতম এলো মাদ্রাজ থেকে। সারা রাত এডিট করে পরের দিন গৌতম মাদ্রাজ ফিরে গেলো আর আমি কলকাতায় চলে এলাম । ১৯শে এপ্রিল, ১৯৮৫ সালে প্রথম পর্ব রাত ৮- ০৫ মিনিটে দেখানো হয়। টেলিকাস্টের দিন কলকাতার সমস্ত দৈনিক বাংলা আর ইংরাজি কাগজে প্রথম পেজে বিরাট করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। টেলিকাস্ট ডেট ঠিক হয় যাওয়ার পর দেবু বাবু ওনার বাড়িতে আমাদের জন্য বিরাট খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন ।
কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম স্পন্সরড প্রোগ্র্যাম ! A 24FRAMES Production Ravishankar – A legend of Glory” for Doordarshan , Kolkata and “Sabdo Jabdo” for DD 2 ……
============================।
Be First to Comment