প্রবীর রায় : বিশিষ্ট অভিনেতা, প্রযোজক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ৯, আগস্ট, ২০২০। Ice Skating Ring থেকে সোজা মুনমুনের বাড়ি। জিজ্ঞাসা করলাম “এবার বলো…তুমি কি অচলা? “মুনমুন হেসে বললো ” হ্যাঁ, আমি অচলা”। জিজ্ঞাসা করলাম , “গৃহদাহ” দেখার পর , তোমার এই সিদ্ধান্তের কারণ?” ও বললো, “মার তখন জন্ডিস হয়েছিল, চেহারা খারাপ হয়েছিল, দেখতে ভালো লাগেনি। সব দেখে মনে হলো, আমি একটা চান্স নিতে পারি।” আমি ওখান থেকেই পরিচালক চাঁদুদাকে ফোন করে বললাম….মুনমুন রাজি হয়েছে। আমাদের ফুল কাস্ট হলো মহিম : রঞ্জিত মল্লিক , সুরেশ : শমিত ভঞ্জ, অচলা : মুনমুন সেন, মৃণাল : পাপিয়া অধিকারী, কেদার বাবু : শৈলেন মুখার্জী, স্মিতা সিনহা, কল্যাণী মণ্ডল ……। কলকাতা দূরদর্শনে প্রথম multi starer ধারাবাহিক। “গৃহদাহ” হচ্ছে আমার প্রযোজক জীবনে এক সুখস্মৃতি। এতগুলো ভদ্রলোক এক জায়গায় … কি অসাধারণ পরিবেশ।
এক জনের কথা এখানে বলতেই হবে….আমাদের সবার প্রিয় শৈলেনদার (শৈলেন মুখার্জী) সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কোনোদিন ভুলবো না । এক বিরাট অভিনেতা, নিপাট ভদ্রলোক। অভিনয় করা ছাড়াও, উনি একটি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। শৈলেন মুখার্জীকে নিশ্চই সবার মনে আছে। ‘চারুলতা”র ভূপতিকে নিশ্চয়ই মনে আছে। কি স্নেহপ্রবণ মানুষ….লিখতে লিখতে আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে …আমার সেই সময়ে পা ভেঙে গিয়েছিলো…রোজ বিকেলের দিকে আমাকে দেখতে আসতেন……আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা বসতেন …চা সিঙ্গারা খাওয়া হতো….আর কত গল্প।
“গৃহদাহ”র শুটিং শুরু হলো, যেন একটা পরিবার। মুনমুন নিজের কস্টিউম এর design করার দায়িত্ব নিয়ে নিলো। অনেকে হয়তো জানেন না মুনমুন খুব ভালো আর্টিস্টও। “গৃহদাহ” তে ওর প্রত্যেকটা Dress এর design ওর নিজের করা। বিরাট স্কেচ খাতাতে design করে নিয়ে আসতো আর চাঁদুদাকে দেখিয়ে approve করাতো। আমাদের অফিসিয়াল কস্টিউম ডিজাইনার ছিল ইন্দ্রানী রায়চৌধুরী। পরবর্তীকালে যে NGO “সংলাপ” শুরু করে আর প্রচুর নামও করে! ইন্দ্রানীও আজ আর নেই আমাদের মধ্যে। ইন্দ্রানীর কথাও খুব মনে পড়ছে আজ। কস্টিউম কিনতে বেরিয়ে আমার আর ইন্দ্রানীর প্রায়ই পার্ক স্ট্রিটের “Peter Cat” এ লাঞ্চ করা, ২ টো করে Gin এর সঙ্গে …সব কিছুই খুব নস্টালজিক। যাক আবার ফিরে আসি শুটিংয়ের কথায়। “গৃহদাহ”র বেশি indoor shoot হয়েছে টেকনিসিয়ান্স ষ্টুডিওতে (1 & 2 )। ঝড়, বৃষ্টির রাতে “সুরেশের” “অচলা”কে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই সেট পড়েছিল NT- 1 স্টুডিওতে! আউটডোর ফলতা গঙ্গার ধারে, নেপাল গঞ্জে ….আর ঘোড়ার গাড়িতে মাঝেরহাট ব্রিজের নিচে।
দুপুরে লাঞ্চে আমাদের খাওয়া দাওয়া যেন পিকনিক। আমার বাড়ি থেকে রোজ খাবার আসতো। পপাইর হাতের রান্না, কিছু স্পেশাল ডিশ। আমাদের মিল সাপ্লাই করতো সন্তোষ । নরমাল মিলের বাইরে, ও রেগুলার এক্সট্রা কিছু ছোট মাছের ঝাল করে আনতো..যেটা মুনমুনের খুব প্রিয় ছিল। তার জন্য এক্সট্রা চার্জ করতো না।
আর শনিবার হলে তো hubby (ভরত), ভরতের এক বন্ধু কিষান আসতো শুটিংয়ে। আর মাঝে মাঝে আমাদের গেস্ট হতেন সুব্রতদা (সুব্রত মুখার্জী) , হৈ হৈ করে শুটিং হতো। আর রোজ প্রেসে ভর্তি ষ্টুডিও ফ্লোর। তার মধ্যে বুবুর (শমিত ভঞ্জ) বদমাইশি। মুনমুন আর শৈলেনদার শট এর সময় বুবু, মুনমুনকে হাসিয়ে দিতো আর বেচারি
মুনমুন চাঁদুদার কাছে বকুনি খেত। এখানে একটা গোপন কথা বলে রাখি । মুনমুন একটু whimsical ছিল….দুমদাম ফ্লোর থেকে বেরিয়ে যেত…..আর চাঁদুদা বকাবকি করতেন …আমাকে চাঁদুদা একদিন বললেন, শোন আমি কিন্তু, মুনমুন গন্ডগোল করলে বকাবকি করবো আর তুই আবার ওকে নরমাল মুডে রাখবি….মুনমুন কিন্তু চাঁদুদাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতো, চাঁদুদার কাজের অসম্ভব ভক্ত ছিল। প্রায়ই চাঁদুদার জন্য গিফট নিয়ে আসতো! আর আমার সঙ্গে ছিল অসম্ভব বন্ধুত্ব .. ..আমরা ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছিলাম! আর “গৃহদাহ” নিয়ে মুনমুনের এক অসম্ভব involvement হয়ে গিয়েছিলো।
রঞ্জিত চিরকালই খুব ভদ্র কিন্তু টুকটাক কমেন্ট করতো মজার মজার । বুবু আর মুনমুন, রঞ্জিতের সঙ্গে খুব খুনসুটি করতো। এক বিরাট পরিবারের মতো ছিল “গৃহদাহ” ইউনিট ! রঞ্জিত, বুবু , এদের সঙ্গে আমার বহু বছরের বন্ধুত্ব ছিল ! বুবু আর রঞ্জিতের সঙ্গে আমি অভিনয়ও করেছি “আজকের নায়ক” আর “নয়নশ্যামা” ছবিতে। আর এক মজার মানুষ ছিলেন ক্যামেরাম্যান দীপকদা (দীপক দাস)। সাউন্ডে ছিল রঞ্জন পান্ডে, শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন বিখ্যাত সুরেশচন্দ চন্দ্র, আর make up এ ভীম নস্কর! এখানে চাঁদুদা সম্বন্ধে একটা কথা বলা প্রয়োজন! যদি সকাল ৯ টায় কল টাইম থাকতো, চাঁদুদা সকাল ৮.৩০ টা থেকে একটা কফি নিয়ে ফ্লোর এর সামনে বসে থাকতেন, টেকনিসিয়ান্সরা কে কখন আসছেন দেখার জন্য। সবাই যেমন চাঁদুদাকে শ্রদ্ধা করতো, তেমনি ভালোবাসতো। টেকনিসিয়ান্সদের পেমেন্ট ঠিক মতো হচ্ছে কি না, সেটাও উনি দেখতেন। এখানে একটা ইন্টারেষ্টিং কথা বলে রাখি, আগে বলতে ভুলে গিয়েছি, যখন চাঁদুদার সঙ্গে পেমেন্ট নিয়ে কথা হলো, তখন আমাকে উনি বললেন, তোর এখানে সবচেয়ে বেশি পেমেন্ট কে পাচ্ছে ? আমি বললাম রঞ্জিত মল্লিক। কত পাচ্ছে সেটাও বললাম…তখন আমাকে চাঁদুদা বললো, উত্তমকুমার ছাড়া আর যেই থাকুক, সবচেয়ে বেশি পেমেন্ট আমি নেবো! টোটাল ধারাবাহিকে রঞ্জিতের থেকে আমাকে ৫০০০/- টাকা বেশি দিবি! উত্তমকুমার না থাকলে, সেই unit এ আমি উত্তমকুমার । আমি দিয়েছিলাম, কিন্তু সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই ৫০০০/- চাঁদুদা ফেরত দিয়ে দিয়েছিলো। আর একটা কথা আমাকে চাঁদুদা শিখিয়েছিলো, কারো rate জিজ্ঞাসা করবি না…তুই বলবি আমি এটা দিতে পারবো, পারলে করুন!
“গৃহদাহ”র শুটিং চলাকালীন আমি আর মুনমুন ঠিক করলাম, আমরা একটা কোম্পানি form করবো, নিয়মিত ধারাবাহিক প্রোডিউস করার জন্য….ন্যাশনাল আর কলকাতায়। মুনমুন, ভরতের সঙ্গে কয়েকটা মিটিং করে আমরা কোম্পানির নাম ঠিক করলাম “Moon Vision Private Limited “. আমি, মুনমুন , ভরত আর আমার স্ত্রী পপাই (সোমাশ্রী) চারজন ডিরেক্টর। “Moon Vision Private Limited ” রেজিস্টার্ড হয়ে গেলো under কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট এ। এরপর একদিন আমি আর মুনমুন দূরদর্শনে গেলাম । সলিলদা, বিদ্যুৎদা (ডেপুটি ডিরেক্টর) আর নির্মল শিকদার (স্টেশন ডিরেক্টর) এর সঙ্গে আমার আর মুনমুনের কথাবার্তা হলো। বলা হলো প্রজেক্ট জমা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ডিরেক্টর কাকে নেওয়া যায়। ইন্দর সেন তখন “গৃহদাহ” নিয়ে ব্যস্ত। আমরা ঠিক করলাম, commercially হিট কোনো ডিরেক্টরকে দূরদর্শনে নিয়ে আসব। সেই সময়ে প্রভাত রায় বেশ হিট ডিরেক্টর…আমি আর মুনমুন প্রভাতদার সঙ্গে কথা বলে ফাইনাল করলাম।
প্রভাতদাকে বললাম প্রজেক্ট রেডি করতে। তখন বোধহয় প্রভাতদার “প্রতীক” শেষের দিকে। “প্রতীক” এর শুটিং NT-1 Studio তে হতো আর তখন “গৃহদাহ”র সেটও NT-1 এ পড়েছে। রাখি গুলজার তখন “প্রতীক”এর শুটিং করছেন । একদিন প্রভাতদা আমার সঙ্গে আর আমার স্ত্রীর সঙ্গে রাখির আলাপ করিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ আড্ডা মারলাম রাখির সঙ্গে। রাখি তার আগে ইন্দর সেনের “চামেলী মেমসাহেব” এ কাজ করেছেন। ওনার সঙ্গে আড্ডা মারার সময়ে অনেকটা জুড়ে ছিল ইন্দর সেনের গল্প। খুব প্রশংসা করলেন ইন্দর সেনের কাজের।
যাইহোক আবার “গৃহদাহ” র কথায় ফিরে আসি। “গৃহদাহ”কেও দর্শকরা খুব ভালো ভাবে নিলো। আসলে তখন আমরা সাহিত্য নিয়ে বেশি ধারাবাহিক করার চেষ্টা করতাম , এখনকার প্রযোজক , পরিচালকদের মতো আমাদের এত প্রতিভা ছিল না। নিজেরা গল্প লিখবো, চিত্রনাট্য লিখবো, গান লিখবো ….এতো ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তাই সাহিত্যধর্মী উপন্যাস বা গল্প নির্বাচন করতাম। আর সেটা দর্শকদের ভালো লাগতো। আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। “গৃহদাহ” র আবহ সংগীত করেছিলেন ভি . বালসারা। আর একজন নিপাট ভদ্রলোক। মনে আছে আমরা “গৃহদাহ”র sync আবহ সংগীত take করেছিলাম ভবানীপুরে “প্ৰসাদ স্টুডিওতে” । রেকর্ডিস্ট্ ছিলেন সুরেন প্ৰসাদ।
এর মধ্যে আমার আবার একটা ঘটনা ঘটলো। টেকনসিয়ান্স স্টুডিওতে শেষ দিনের আগের দিন শুটিং হয়ে গেলো । পরের দিন শেষ শুটিং ফলতা গঙ্গার ধারে। সুরেশের শেষকৃত্য …. ভোর ৬টায় কল টাইম …. টেকনিসিয়ান্সে । ওখান থেকে আমাদের গাড়ি , স্টুডিও ভ্যান বেরোবে ৬.৩০টায়। মুনমুন বোম্বে থেকে আসবে সকালে । প্ল্যান হলো আমি গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্ট যাবো। সেই মতো হাবি বললো, আমিও একটা গাড়ি পাঠাবো এয়ারপোর্টে….তাতে মুনমুনের luggage নিয়ে গাড়ি চলে যাবে ওর বাড়ি আর আমি মুনমুনকে নিয়ে সোজা স্পটে। এই সব প্ল্যান করে বাড়ি ফিরছি ….খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন। আমি দৌড়ে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে, গেটে পা ঢুকে একদম উল্টে পড়লাম। হাতে একটা whisky র bottle ছিল !! সেটা বাঁচালাম কিন্তু পাটা বাঁচাতে পারলাম না । অসহ্য যন্ত্রনা…বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে সব কন্টাক্ট করে সব প্রোগ্র্যাম চেঞ্জ হলো । আমি যেতে পারলাম না পরের দিন। পরের দিন সকালে আমার x ray হলো। ডান পায়ের টিবিয়া দু টুকরো। তার পরের দিন অপারেশন। পরের দিন সবাই শুটিং থেকে সোজা আমার বাড়ি…..আর আমি ৫ মাস bed ridden।
হাতে তখন অনেক কাজ আসছে। দূরদর্শনে তখন ছায়াছবির গান নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হতো, বোধহয় প্রত্যেক বৃহস্পতিবার। অনুষ্ঠানটির নাম ছিল “চিত্রমালা”। ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে পেমেন্ট নিয়ে গন্ডগোলে “চিত্রমালা” বন্ধ হয়ে গেলো । তখন আমি একটা প্রস্তাব দিলাম “চিত্রমালা”-র পরিবর্তে ৫০ আর ৬০ এর দশকের নন-ফিল্ম (বেসিক) হিট গানগুলি নিয়ে সেই সময়ের নামকরা অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে শুটিং করা হোক। একেকটা এপিসোড একেকটা আলাদা স্টোরি হবে …. কোনো সংলাপ থাকবে না। আমাকে বিদ্যুৎদা (Deputy Director B.K. Saha) বললেন, তুমি এটা কমিশনড প্রোগ্রাম হিসেবে জমা দাও। আমি অনুমোদনের জন্য দিল্লী পাঠিয়ে দিচ্ছি …. মানে দূরদর্শন প্রোডিউস করবে।
এদিকে আমি তো বিছানায় পড়ে সব লন্ডভন্ড !! কি করি……..!!!!! ক্রমশ …….
Be First to Comment