Press "Enter" to skip to content

হারানোদিনেরকথামালা……

Spread the love

প্রবীর রায় : বিশিষ্ট অভিনেতা, প্রযোজক ও চিত্র পরিচালক। ১৬, আগস্ট, ২০২০। অসম্ভব জনপ্রিয়তা নিয়ে “গৃহদাহ” টেলিকাস্ট শেষ হলো। “গৃহদাহ” মোট ৩ বার দেখানো হয়েছে । পরবর্তীকালে এক বার কলকাতা দূরদর্শনে , আর একবার দিল্লী মেট্রো চ্যানেলে দেখানো হয়। “গৃহদাহ” “বেস্ট টিভি সিরিয়াল অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া” পুরস্কারও পেয়েছিলো। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম “বিচিত্র তদন্ত”ও এই পুরস্কার পেয়েছিলো। পর পর দু বছর এই পুরস্কার আমরা পাই।

পরের টিভি সিরিয়ালের ব্যাপারে যাওয়ার আগে আমার অভিনয়ের কথা একটু বলা প্রয়োজন। আমি প্রথম এই প্রফেশনে আসি অভিনয় করবো বলে । তখন টিভি সিরিয়াল শুরু হয়নি। তাই ফিল্মে অভিনয়ের চেষ্টা করতাম। প্রথম অভিনয় করি দীনেন গুপ্তর “আজকের নায়ক” ছবিতে, যেটা সুমিত্রা মুখার্জীর প্রথম ছবি। নায়ক ছিল শমিত ভঞ্জ। আমি, শমিত , কল্যাণ চ্যাটার্জী আর রবিদা (রবি ঘোষ) চার বন্ধু ছিলাম । ছোট চরিত্র।

এর পর অডিশন দিয়ে প্রধান চরিত্রে। পাই শীর্ষেন্দু মুখার্জীর উপন্যাস “নয়ন শ্যামা” ছায়াছবিতে । পরিচালক ছিলেন নীতিশ মুখার্জী । আমি নয়নের ভূমিকায় অভিনয় করি আর শ্যামার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুমিত্রা মুখার্জী । এ ছাড়া এই ছবিতে একটা রোমান্টিক চরিত্রে ছিলেন রঞ্জিত মল্লিক আর বিশেষ চরিত্রে ছিলেন সন্তু মুখার্জী। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সুমিত্রাকে কাস্ট করার আগে নীতীশদা তখনকার আর এক পরিচিত নায়িকাকে কাস্ট করেন কিন্তু ওই নায়িকা নতুন ছেলের বিপরীতে অভিনয় করতে অস্বীকার করায় সুমিত্রার কাছে যাওয়া হয়। সুমিত্রা নীতীশদাকে বলেন , “আপনি কাকে কাস্ট করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার, সে নতুন হোক আর পুরোনো সেটা আমার দেখার কথা না ! আমি শুধু আমার অভিনয়টা করবো” ।

সেই দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত “হাসি” (সুমিত্রা) আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। এই ফিল্মে আর একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল মহুয়া রায়চৌধুরীর। কিন্তু শুটিং শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে ওর পক্স হয়ে যাওয়ার জন্য একটি নতুন মেয়েকে নেওয়া হয় ।
এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ যে অভিনয় আমার প্যাশন ছিল । তখন রেগুলার গ্রুপ থিয়েটার করতাম বরুণ দাশগুপ্তর গ্রুপে। অনেক বিখ্যাত নাটকে অভিনয় করেছি । রেডিও নাটক করেছি “ডাউন ট্রেন” । বিভাসদার (বিভাস চক্রবর্তী) প্রোডাক্শনে টিভি নাটকও করেছি রবীন্দ্রনাথের “সে’ । কিন্তু স্টুডিওতে ঘুরে ঘুরে ” সুযোগ দিন” বলতে সম্মানে লাগতো তাই ভাবলাম, নিজেই প্রোডিউসার হয়ে যাই, তাহলে কাউকে আর তেল মারতে হবে না । কিন্তু সেটাও দেখলাম সম্মানের ব্যাপার হয়ে গেলো….তখন তো সবাই বলবে নিজে প্রোডিউসার তো তাই নিজেই হিরো হচ্ছে .. . অতএব সেটাও হলো না । সেই ভাবে অভিনয় আর করাই হলো না । কিছু কিছু মানুষ ডাকতেন, তাদের ফিল্ম বা সিরিয়ালে অভিনয় করেছি যেমন “একদিন সূর্য”, রবীন্দ্রনাথের “রবিবার”, দেবব্রত মুখার্জীর “ইফ”, নবেন্দু চ্যাটার্জীর “আজ কাল পরশুর গল্প”, শচীন অধিকারীর “নতুন সূর্য” ইত্যাদি ।

সিরিয়াল অবশ্য অনেক করেছি। Best Actor Award ও পেয়েছি ! “নয়ন শ্যামা” তো ১৯৮৪ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইন্ডিয়ান প্যানারোমাতে নির্বাচিত ছবি ছিল। আমি নিজে সেখানে ডেলিগেট হিসেবে উপস্থিত থাকতে পেরে সম্মানিত হয়েছি। কিন্তু নিজের প্রযোজনায় দু একটা ছোট ক্যারেক্টার করা ছাড়া আর বিশেষ অভিনয় করার সুযোগ হয়ে উঠলো না।

এটাই হচ্ছে আমার প্রযোজক হওয়ার পেছনের কারণ । কিন্তু প্রযোজকই রয়ে গেলাম…আর অভিনেতা হওয়া হওয়া হলো না । স্বপ্নের জীবন থেকে আবার ফিরে আসি প্রযোজকের বাস্তব জীবনে । যেদিন শচীনদার “নতুন সূর্য’ র আউটডোরে যাবো বক্রেশ্বরে , সেইদিনই টেলিগ্রাম এলো দূরদর্শন থেকে …..”হারানো সুর” অনুমোদিত !! আমি বাজেট দিয়েছিলাম প্রতি এপিসোড ৮১,০০০/- , আর দিল্লী অনুমোদন করেছিল ৫২,০০০/- করে । আমাকে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করতে বলা হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এর সঙ্গে । তখন ডিডি২ র ওই ডিপার্টমেন্ট দেখতেন বোধহয় প্রণবেশ (প্রণবেশ ঘোষ) অথবা অজিতদা (অজিত মুখোপাধ্যায়) ! আমার ভুলও হতে পারে….এতদিনের কথা তো !! আমি ফোন করে বললাম….কলকাতার বাইরে যাচ্ছি, ৫ দিন পর ফিরে এসে দেখা করছি ।

সাল টা ১৯৮৯র জানুয়ারির শেষ ! বক্রেশ্বর গিয়েছিলাম গাড়িতে। আমার গাড়িতে শুধু আমি, পাপিয়া (পাপিয়া অধিকারী) আর পাপিয়ার attendant একটি মেয়ে । তার কদিন পরেই পাপিয়ার বিয়ে। মনে আছে ও কার্ডও নিয়ে গিয়েছিল ইউনিট মেম্বারদের নিমন্ত্রণ করবে বলে । ওর বিয়ের ডেট ছিল বোধহয় 27th February , 1989 । যাই হোক গাড়িতে পাপিয়া সব শুনলো “হারানো সুর” এর প্ল্যান….কি ভাবে আমি করতে চাই ! পাপিয়া আমার সব সিরিয়ালেই তখন অভিনয় করতো…”নতুন সূর্য”তে আমি পাপিয়ার কথা বলেছিলাম শচীনদাকে। সব শুনে পাপিয়া বললো, শুধু অভিনয় না, আমি তোমার সঙ্গে Directorial ডিপার্টমেন্ট এ involve থাকতে চাই…আমার ভবিষতে ডিরেক্টর হওয়ার প্ল্যান আছে ! আমি বললাম, ঠিক আছে কলকাতায় ফিরে সব ফাইনাল করবো !


বক্রেশ্বরে আমাদের “নতুন সুর্য” র শুটিং ছিল ৫ দিন …ছিলাম বক্রেশ্বর টুরিস্ট লজে। খুব হইচই করে ৫ দিন শুটিং করলাম। শচীনদা ছাড়াও স্বপন, উৎপলদা (যাত্রার বিখ্যাত নাট্যকার ও পরিচালক), বুড়ো মামু (তরুণ কুমার), পাপিয়া এবং আরো অনেকে। শুটিংয়ের পর রাতে দারুন আড্ডা হতো। একদিন আমি আর পাপিয়া তারাপীঠও ঘুরে এলাম।

একটা গানের প্রথম অন্তরা পর্যন্ত ওখানে টেক হলো…খুব মিষ্টি রোমান্টিক গানটা “এই তো সেদিন ফাগুন বেলায়, তুমি এলে আমার কাছে”….গানটা গেয়েছিলেন সৈকত মিত্র আর অরুন্ধতী হোমচৌধুরী । সুর দিয়েছিলেন দ্বিপেন বন্দ্যোপাধ্যায় ….দ্বিপেনদা আজ আর নেই।
শুটিং শেষে ফিরে এলাম কলকাতায়। এসেই পড়লাম “হারানো সুর” নিয়ে । দূরদর্শনের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট হয়ে গেলো। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী ৪০% অ্যাডভান্সও পেমেন্ট করে দিলো । এখানে একটা কথা বলে রাখি দূরদর্শন খুব মুষ্টিমেয় কিছু প্রোডাকশন হাউসকে Commissioned Programme approve করেছিল ।

“হারানো সুর” ছিল ডিডি২ র অনুষ্ঠান। এর সঙ্গে ডিডি২ তে স্পন্সরড প্রোগ্র্যাম এর জন্য আর একটা স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছিলাম। নাম ছিল #শব্দজব্দ, একটা বিদেশী গল্প অবলম্বনে ক্রাইম থ্রিলার । পরিচালক ছিলেন দেবরাজ রায়। সেটাও তখন অনুমোদনের পথে । “শব্দজব্দ”র কথায় পরে আসছি।
“হারানো সুর” টা সাজালাম এই ভাবে । প্রত্যেক পর্বে ৫/৬ টা করে গান দিয়ে একটা গল্প তৈরি হবে । কোনো সংলাপ থাকবে না। গানগুলো নিয়েছিলাম ৫০ আর ৬০এর দশকের বিখ্যাত সব বেসিক গানের সম্ভার থেকে। ছায়াছবির গান নয়। HMV থেকে অনুমোদন নিতে হয়েছিল প্রতিটি গান ১০০০/- টাকা দিয়ে। প্রথমে ১০ টা গানের টাকা পেমেন্ট করার পর, কপিরাইট Act থেকে জানানো হলো, HMV র কোনো টাকা নেওয়ার বা পারমিশন দেওয়ার রাইট নেই । রাইট ওদের কাছ থেকেই নিতে হবে। প্রতিটি এপিসোড মাত্র ২৫০ টাকা। আর ওই গান গুলো লেন্সবন্দী করলাম তখনকার সব শিল্পীদের দিয়ে।
Title song ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে …..”
প্রথম পর্বের গান গুলো ছিল….”তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে”, “প্রেম একবারই এসেছিলো নীরবে”, আর কত রহিব , শুধু পথ চেয়ে”, “ওগো মোর গীতিময়”, “পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়” আর “স্মৃতি তুমি বেদনার”। এই পর্বে অভিনয় করেছিলাম আমি আর পাপিয়া অধিকারী। এই পর্বের শুটিং হয়েছিল দীঘা আর ওমর রিসোর্ট , জোকাতে। একজন আর্মি অফিসার যুদ্ধে নিহত হন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে দুজনের কিছু রোমান্টিক মুহূর্ত আর নিহত হওয়ার পর বার বার তাকে দেখা আগের মতো করে। মোটামুটি এই ভাবে প্রথম পর্বকে সাজানো হয়েছিল । এখানে আমার লিপে ছিল দুটো গান…. “আর কত রাহিব শুধু পথ চেয়ে ” আর “পৃথিবী আমারে চায় “

“হারানো সুর”এর চিত্রগ্রাহক ছিলেন শঙ্কর ব্যানার্জী (শঙ্করদা আজ আর নেই)। “হারানো সুর” এডিট হতো মহান্তি আর সুমিতাভর “Videographics ” এ , লেক গার্ডেনসে !! সম্পাদনা করেছিলো তাপস চক্রবর্তী । গান খুব ভালো কাটতো তাপস । ওর মধ্যে একটা গানের সেন্স ছিল। রিদম্ সেন্স ছিল । তাপসও আজ আমাদের মধ্যে নেই !! পূজা পরিক্রমা কভার করতে, গিয়ে অল্প বয়েসে car accident এ চলে যায় !
সেই সময়ে মুনমুনের husband (ভরত) এর পা ভেঙেছিল , ঠিক আমার মতো ..Tibia টা দু টুকরো ! মুনমুন তখন খুব সেবা করতো ভরতকে ! কারণ ভরত তখন একদম শোয়া ! “হারানো সুর” হচ্ছে শুনে আমাকে বললো, “প্রবীর. আমি করবো না এতে ?” আমি বললাম , তুমি তো এখন সেবাতে ব্যাস্ত…..ও বললো , না আমি অন্তত একটা গান এ লিপ দেব ! আমি বললাম, ঠিক আছে কিন্তু আমার Next lot night shoot হবে নরেন্দ্রপুর Regency Gardene এ, (যেটা এখন নরেন্দ্রপুর Sherwood residential কমপ্লেক্স) ! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পারবে Night shoot করতে ? মুনমুন বললো “পারবো” !
এরপর পরের সংখ্যায় ……

ক্রমশ ….

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.