ডঃ পি সি সরকার (জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। ৫, জানুয়ারি, ২০২১। আমার বাচ্চা হাতি তখন আর বাচ্চা নেই। এমনিতেই ওর নাম যে আসলে 'বাচ্চা', সে কথাটা লোকে কেমন চট্ করে ভুলে গেলেন। মুখে মুখে হয়ে গেলো 'বাদশা'। সরকারী বন-দপ্তরে ওর নাম রেজিস্ট্রি করার অফিসার খুব কড়া মেজাজের। নাকের ডগায় চশমা এনে কাগজে কি একটা লিখতে লিখতে, মুখ না তুলেই বলেন "ওর নামটা ঠিক মতো বলুন"। আমি বললাম "সেটা তো লিখেই দিয়েছি, বিশ্বাস না হলে ওকেই জিজ্ঞেস করুন, আমাকে কেন বলছেন? "ভদ্রলোক বললেন, "এটা সরকারি অফিস। নথিপত্র ঠিক রাখতে হয়, বুঝলেন! এক হাতির নাম করে অন্য হাতির লাইসেন্স
নেওয়া বন্ধ করতে আমাকে সরকার মাইনে দিয়ে রেখেছেন।”
জবাবে আমি হাসি। বলি, “কোন সরকার?”
-“তার মানে?”
-” কতো এলো গেলো, একমাত্র স্থায়ী সরকার তো দেখছি আমিই!!”
ভদ্রলোক এতক্ষণে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর হঠাৎ আবিষ্কার করার মতো দেখে চমকে বললেন-“ওঃ আপনি !!! আমি খেয়াল করিনি ।আসলে আজকাল এতো ভূয়ো হাতির নামে এতো…
-“এ তল্লাটে আর কোনো কারুর পোষা হাতি আছে ? নাকি জঙ্গল থেকে কেউ ধরে-টরে টেনে নিয়ে আসে ?”
-“না আসলে লেখা আছে হাতির নাম ‘বাচ্চা’, কিন্তু সবাই বলছে ‘বাদশা’!! কোনটা কারেক্ট জানতে চাইছিলাম আর কি।”
-“ওর নাম রেখেছি ‘বাচ্চা’, আর ওর ডাকনাম হলো
‘বাদশা’ । পুরো নাম ‘বাচ্চা হস্তিনী সরকার’।”
–“ঠিক তাই লিখবো কিন্তু!!”
–“বলছি তো লিখুন।”
ভদ্রলোক লিখলেন। আমি রেজিস্ট্রেশনের সার্টিফিকেট পেলাম, তাতে হাতির নাম হিসেবে লেখা আছে,’বি.এইচ.সরকার (বাচ্চা হস্তিনী সরকার)।
যদি বিশ্বাস না করেন তো আমার কাছে চলে আসুন। দেখিয়ে দেবো। আমি বাঁধিয়ে রেখেছি।
লোকে বেশি খেলে পরে বলে, ‘হাতির খোরাক’। বালাই ষাট। নজর দিতে নেই। হাতি যতক্ষণ জেগে থাকে, ও ততক্ষণ খেতেই থাকে। ঠিক আমাদের নেতাদের মতো। মুখ কখনো বন্ধ থাকা উচিত নয়। সত্যি- মিথ্যে বুঝি না, আমাদের মাহুত মহাশয় তো আমায় তাই বুঝিয়েছেন। আমিও ঢোক গিলে বলেছি,”ঠিক হ্যায়, কন্টিনিউয়াসলি খিলাও। কিন্তু রয়ে সয়ে, বাজেট বুঝে খিলাও। “ও বলে, “বাজেট কিত্না?”
আমি বলি, “লোকে বোলতা হ্যায়, হাতি পুষনা বহুত খরচের ব্যাপার হ্যায়। আমি আগে অতোটা নেহী জানতা থা। এখন একটু ভয়-ডর কর্তা হ্যায়। কনসেশনমে ভেবে চিন্তে আমাকে বাঁচিয়ে রাখনা”।
ও জবাবে বলে, “মেরা মাহিনা কিত্না?”
ওরে বাবা, তাইতো! ওকেও তো মাইনে দিতে হবে।তাছাড়া, মাহুতেরও শোবার, খাবার রান্না করার ব্যবস্থাও করতে হবে। ওর বৌকে এখানে এনে থাকানোর, শরীর খারাপ হলে দেখভাল করতে হবে। ছট্ পূজোতে দেশে যেতে দিতে হবে। মুলুক থেকে দেশোয়ালী ভাই এলে কইলকাত্তা শহর ঘুমাকে দিখলানা পরেগা।
এহ বাহ্য। ও হাসতে হাসতে বললো, “পুজামে বোন্নাস দেনা পরেগা। নেহীতো, নোকড়ি ছোড় দেঙ্গে। আপনার হাতি আপনি সামলাবেন।
এত্তোটা ভাবিনি। ব্রেণে আটেনি।
এভাবে পনেরোটা বছর কাটিয়েছি। ইতিমধ্যে মাহুতদার দুটো ছেলে হয়েছে। দুজনেই নাদুশ- নুদুশ, থলথলে (টাচ উড) হয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু শুকিয়েছে আমার হাতি। একটি করে সন্তান জন্মেছে, মাইনে বাড়াতে হয়েছে। পার্টির হয়ে আমাদের বাড়ির দেওয়ালে লিখে কামিয়েছে। আপত্তি করায় সেই পার্টির দাদারা, ভাইয়েরা এসে বলেছে রাস্তায় হাতিকে হাঁটতে দেবে না। লোকালয়ে থাকতে দেবে না। ওর মাইনে বাড়াও, হাতির খাবারের হিসেব চেয়ে জন্তুর কাছে মানুষের অপমান করো না, সমস্ত অধিকার ফিরে পাবে।
শুনলাম একদিন, হাতি নাকি আমার খু–ব অসুস্থ। শুয়ে আছে। উঠছে না। স্হানীয় পশু চিকিৎসক বলছেন ওর পেটে অ্যসিড হয়েছে। জেলুসিল খাওয়াতে হবে। তিন-বেলা। যতদিন না সারে।
–খাওয়ান।
ডাক্তারবাবু ডোজ লিখে দিলেন। এক লিটার করে তিন বেলা।
এক লিটার মানে চেনাশোনা 200ml -এর শিশির পঞ্চাশ শিশি। প্রতি বেলায়!!!!
আমি ঢোক গিলে বলি, পঞ্চাশ শিশি নয়, একান্ন শিশি করুন, প্লীজ !! এক শিশি আমার জন্য!!
নাঃ। আমাকে ব্যাঙ্কের এফ্.ডি. ভাঙ্গাতে হয়নি।ডাক্তারবাবুই সমাধান করে দিয়েছেন। মাহুতের সঙ্গে আড়াল ফিশফিশ গুজগুজ করে আমায় এসে বললেন। “মাহুতের মাইনে পাঁচশো টাকা বাড়িয়ে দিন, সব সমাধান হয়ে যাবে।”
–সত্যিই
—হ্যাঁ, তার কমে রাজী হচ্ছে না।
—রাজী।
হাতিকে ও দাঁড় করিয়ে দিলো।
অনেকদিন পর মাহুতের ছোট ছেলে মানেকার সঙ্গে গল্প করতে করতে বলে— ওর বাবাও ম্যাজিক জানে, আর সে ম্যাজিক মানেকার বাবাও জানে না। কুড়িটা আস্তো সুপুরি, আর পঞ্চাশটা পানপাতা এক সাথে খাওয়ালে হাতির সব রকম পেট খারাপ সেরে যায়।
শিখলাম। কিন্তু জানলাম না ঠিক শিখেছি কিনা। কারণ, তার এক মাসের মধ্যেই আমি দক্ষিণ ভারতের এক মন্দিরে, ওকে দান করে দিয়েছিলাম। অনেক হাতির সঙ্গে ও সুখে আছে, ওর সংসার নিয়ে।
দুঃখ শুধু একটাই, মহাজাতি সদনে হাতি অদৃশ্য করে বিশ্ব-জাদু রঙ্গমঞ্চে রেকর্ড সৃষ্টি করা বা
রূপকথাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করাটা, আর মোটেই হবে না। কোনো দিনও না। ম্যাজিক হবে ছোট ছোট হাতের খেলায়, রথের মেলায় যা বিক্রী হয়, তাতে। তাস বা পয়সা ভ্যানিশ করে।
অবশ্য তাতে কারুর ভারী বয়েই গেছে।
Be First to Comment