প্রবীর রায় : অভিনেতা প্রযোজক ও চিত্র পরিচালক। ১৯ জুলাই, ২০২০। দেশে প্রথম রঙ্গীন TV Coverage করে মিশ্র অভিজ্ঞতা হল জীবনে। একদিকে নতুন একটা কাজ করার অপার আনন্দ, অন্যদিকে বিপ্রতীপে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি……
ভাবতে বসলাম। ভাবতে বসে মনে হল এবারে এমন কোনো মানুষকে নিয়ে কাজ করতে হবে যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ভাবতে ভাবতে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল- পন্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে কাজ করলে কেমন হয়! পন্ডিত রবিশঙ্করের তখন দুনিয়া জোড়া নাম। তখন উনি বিটলস–এর সঙ্গে কাজ করছেন, ইহুদী মেনুহিনের সঙ্গে যুগলবন্দী করছেন। এ দেশে থাকেন না। মাত্র দু মাসের জন্য এ দেশে আসতেন, বাকি দশ মাস বাইরে। ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে আসতেন। ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ওঁর অনুষ্ঠানের টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি হত। বিদেশের টিভিতে উনি অ্যাপিয়ার করেছেন কিন্তু ভারতীয় টিভিতে তখনো পর্যন্ত ওঁকে দেখা যায় নি। সুতরাং স্থির করলাম এবারে ‘পন্ডিত রবিশঙ্কর জী’।
কিন্তু ওঁর কাছে পৌঁছব কি করে? ভাবতে ভাবতে চৈতিদির কথা মনে হল। চৈতি চ্যাটার্জী প্রখ্যাত শিল্পী সুপ্রীতি ঘোষের কন্যা। চৈতিদির কাকা ছিলেন বিমান ঘোষ- His Masters’ Voice (HMV) তে উচ্চপদে আসীন। ভাবলাম উনি হয়তো আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি চৈতিদিকে বললাম, “ আমাকে শুধু একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দাও। “ বিমানবাবু তখন থাকেন বালিগঞ্জে ফাঁড়িতে প্রেসিডেন্সি কোর্টে। ব্যাচিলার মানুষ। চৈতিদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিল। আমি গেলাম বিমানদার বাড়িতে- প্রস্তাবটা রাখলাম যে আমি পন্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করতে চাই, শুধু রাইট আমাকে দিতে হবে। শুনে বিমানদা একটু সংশয়ী- ‘উনি কি রাইট দেবেন? উনি কাউকেই রাইট দেন না। ‘আমার ভাগ্যটা ভাল। পন্ডিতজী তার এক মাসের মধ্যেই কলকাতায় আসছেন। সালটা ১৯৮৩ র শুরু।
তখন কলকাতায় এলে রবিশঙ্করজী দু জায়গায় উঠতেন। একটা হচ্ছে এলগিন রোডে (উডবার্ণ রোডের ক্রসিং-এ) জাহাজবাড়ি। অথবা বালিগঞ্জ পার্ক রোডে লালা ভরতরাম চরতরাম ( ডি সি এম গ্রুপ / ঊষা কোম্পানীর মালিক)- এর বাড়ি। বিমানদা আমাকে যোগাযোগ রাখতে বললেন। পন্ডিত রবিশঙ্কর এলেন, উঠলেন এলগিন রোডের বাড়িতে। নির্ধারিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট মতো বিমানদার সাথে গেলাম সে বাড়ি। গিয়ে দেখলাম- প্রচুর লোকজন দেখা করতে এসেছে, খুব ভীড়। আমাকে দোতলার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল- একা বসে রইলাম। মিনিট পনেরো পরে পন্ডিত রবিশঙ্কর এলেন। ওঁকে দেখেই আমি কি রকম হয়ে গিয়েছিলাম। উঠে প্রনাম করে আমার প্রস্তাবটা নিবেদন করলাম। উনি সব বুঝতেন, বললেন- ‘ কভারেজ তো করবে, এর আগে কি কাজ করেছ?’ তখন তো একটাই কাজের অভিজ্ঞতা আমার ঝুলিতে- নেহেরু গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্ণামেন্টের কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ কটা ক্যামেরা দিয়ে কভার করবে? দেখো, আমি বিদেশের টিভিতে অ্যাপিয়ার করেছি কিন্তু ভারতীয় টিভিতে কখনও করিনি। ‘তখন Central Broadcasting Minister Mr. L.K. Bhagat. বললেন- Mr. Bhagat –ও আমাকে অনুরোধ করেছেন কিন্তু আমি রাজী হইনি, কারণ আমি মনে করি না এদেশে সেরকম প্রোফেশ্যনালভাবে কোনো কাজ হয়…। আমি প্রার্থনা জানালাম, ‘আমাকে একটা সুযোগ দিন।‘
তার মাসখানেক পরেই নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পন্ডিত রবিশংকর- আল্লারাখার অনুষ্ঠান। আর ছিলেন নজাকত আলি-সদাকত আলি। পন্ডিতজী আমাকে বললেন- ‘ঠিক আছে, তুমি বিমানের সঙ্গে এসেছ। আমার অনুষ্ঠান রেকর্ড করো কিন্তু আমাকে না দেখিয়ে … আমার অনুমতি ছাড়া তুমি টেলিকাস্ট করতে পারবে না।‘ তাতেই রাজি আমি। এগ্রিমেন্ট হলো। এগ্রিমেন্ট তো হলো। আবার সেই ক্যামেরার সমস্যা। কলকাতায় কালার ক্যামেরা নেই। আবার দৌড়লাম বোম্বেতে Western Outdoor Advertising Companyতে। বললাম সব। ওরা শুনে টুনে বলল- “ঠিক আছে, তবে এবার ক্যামেরা বোম্বে থেকে নিতে হবে না। কলকাতায় আমাদের টোটাল সেট আছে উইথ অনলাইন কনসোল অপারেশন সিস্টেম for Calcutta Race coverage, আমরা ওখান থেকেই পাঠিয়ে দেব! ক্যামেরা অপারেটর ও ওখানে আছে! বোম্বে থেকে শুধু রমজান শেইখ আর রুই জয়সোয়াল যাবে!
ক্যামেরার ব্যবস্থা করে ফিরে এলাম। আমার এই প্রোজেক্ট স্পনসর করেছিল Bank of Maharashtra। পন্ডিতজীর নাম শুনে তো ওরা খুব আগ্রহী হল। অনুষ্ঠান হয়েছিল জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী নাগাদ (সঠিক তারিখটা মনে নেই)। আবার শঙ্করদাকে ডাকলাম। শঙ্করদা সব দেখে শুনে বললো- ‘এই লাইটে কভারেজ হবে না, এক্সট্রা লাইট লাগাতে হবে। ‘এবারে কল্পনা করলাম- নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সিলিং- কতো উঁচু। তাও সেখানে আমার লাইট হল। অনুষ্ঠানের দিন… কভারেজ শুরু হল। অনুষ্ঠানের মাঝ পথে হঠাৎ দর্শকমহল থেকে আপত্তি- সিলিং-এর এক্সট্রা লাইট থেকে অসুবিধে হচ্ছে। বাধ্য হলাম আমদের লাইট নিভিয়ে দিতে। কিন্তু কভারেজ বন্ধ না করে শেষ করলাম। আমি বিভিন্ন সংস্থায় যোগাযোগ করেছিলাম! রিয়ালেন্স কোম্পানীর Executive Vice President Mr. G. K. Krishnamurthy- র কাছ থেকে টেলেক্স পেলাম – রবিশঙ্করের নাম শুনে ওরা এই অনুষ্ঠানটা স্পনসর করতে আগ্রহী। এবারে আমার শিল্পীর অনুমতি নেবার পালা। এডিটিং করে দেখলাম Programme এর Brightness অনেক কমে গেছে (সেই এক্সট্রা আলো নিভিয়ে দিতে হয়েছিল বলে)। যাইহোক এবার তো পণ্ডিতজি কে দেখাতে হবে পারমিশন নেওয়ার জন্য! গেলাম ওনার বেনারস এর বাড়িতে! যতদূর মনে পরে বাড়িটার নাম “অরুণালায়”….ভুল ও হতে পারে !! উনিও গিয়েছিলেন তখন ওখানে দিন তিনেকের জন্য !! সঙ্গে সর্বক্ষণের সঙ্গী দুবেজি! বেনারসে আমি ছিলাম ওনার বাড়িতে ৩ দিন ওনার অতিথি হয়ে! সে এক দারুন অভিজ্ঞতা! কত রকম গল্প হতো খাওয়ার টেবিলএ! ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল সঙ্গীত থেকে উত্তম কুমার থেকে সত্যজিৎ রায়! ওরকম হোস্ট ও আমি আমার জীবনে খুব কম পেয়েছি! সব হলো কিন্তু ভিডিও দেখানো হলো না !! কারণ ওখানে ওনার কোনো VCR ছিল না! বললেন এক কাজ কারো প্রবীর ..তুমি দিল্লী চলে এস, ওখানে দেখে নেবো! ওখান থেকে ফেরার সময়ে আমার wife Popai কে (Somasree ) একটা চিঠি দিয়েছিলেন, সেটা আজ আজও আমার বাড়িতে আছে ! তখন পন্ডিতজী দিল্লীতে ৯৫, লোদী গার্ডেন রোডের বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটি তাঁকে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। গেলাম দিল্লী- উঠলাম কনট প্লেসে অশোক যাত্রীনিবাসে। এটা ১৯৮২-র এশিয়ান গেমসের সময় তৈরি হয়েছিল। ওঁর বাড়ি গেলাম। তখন ওঁর বাড়িতে কোনো ভি সি আর ছিল না। এই অনুষ্ঠান দেখবেন বলে ওনার সেক্রেটারী দুবেজীকে দিয়ে ভি সি আর কিনে আনলেন। দুবেজী ছিলেন অল ইন্ডিয়া সেক্রেটারী- বেনারসের মানুষ আর কলকাতার সেক্রেটারী ছিলেন রবীন পাল। এবারে ওনার বেডরুমে, খাটের উপর বসে নতুন ভি সি আর-এ অনুষ্ঠানটা দেখা হল। সব দেখেশুনে উনি বলেন …… এখনো আমার কানে বাজে… “ What you think Prabir? Should I approve it? যেখানে আমি I & B Minister কে refuse করেছি, সেখানে কি আমি এটা অ্যাপ্রুভ করতে পারি? তুমি কি বলো?”
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ এটা করতে তোমার কতো খরচ হয়েছে?’ বললাম ’৬৫০০০-৭০০০০ টাকা। শুনে বললেন- এখন আমার কাছে অতো টাকা নেই। আমার কাছে থাকলে, তোমাকে দিয়ে দিতাম টাকাটা! শুনে আমার চোখে জল এসে গেলো! আমি বললাম, আপনি কেন দেবেন টাকা? আপনি বরং আমাকে আর একটা ডেট দিন! উনি বললেন, এরকম পাব্লিক ফাংশানে তুমি টিভির জন্য কভারেজ করতে পারবে না। তোমাকে আমার জন্য এক্সক্লুসিভ শ্যুট করতে হবে। তোমার মতো করে লাইট করে shoot করতে হবে। “সেটা ছিল মার্চ ১৯৮৪। আমাকে বললেন- “ ৯/১০ সেপ্টেম্বর তুমি বোম্বেতে আমাকে নিয়ে এক্সক্লুসিভ shoot করো। “দুবেজীকে বলে আমার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করে নিলেন। মনে আছে- সেদিন ওনার সঙ্গে ডিনার করে, ওনার গাড়ি রাত দেড়টা নাগাদ, আমাকে অশোক যাত্রীনিবাসে পৌঁছে দিয়েছিলো।ফিরে এলাম কলকাতায়। Bank of Maharashtra-র সঙ্গে কথা হল- আনুপুর্বিক সব বললাম। সব শুনে ওরা আমার ইন্টারেস্টটা মকুব করে দিল। বললো- বোম্বের শুটিং-এর পর টাকাটা ফেরৎ দিলেই হবে। এবারে বোম্বে যাত্রা- আবার Western Outdoor Advertising Company তে। WOAC আশ্বাস দিল- কোনো অসুবিধে নেই, এখানে প্রচুর ক্যামেরা পাওয়া যাবে। অনুষ্ঠানের জন্য ৫০০০ টাকা দিয়ে হল বুকিং হল জুহু-তে VAIDAS Auditorium। এবার আমার নিজস্ব অনুষ্ঠান- সুতরাং নিজের মতো প্রোগ্রাম সাজালাম। ঠিক হল- তিনটি আধ ঘন্টার অনুষ্ঠান হবে, আরেকটা এক ঘন্টার লাইভ অনুষ্ঠান রেকর্ডিং করব। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ কলকাতায় ওঁর ভাইপো ভূদেবশঙ্কর আমাকে ফোন করে বললেন- ‘কাকা ইন্ডিয়াতে এসেছেন, দিল্লীতে আছেন। তোমার সঙ্গে খুব দরকার, যোগাযোগ করো তখন আশীষদা- চৈতীদির বাড়ি থেকেই সব ট্রাঙ্কল করতাম। করলাম যোগাযোগ। রবিশংকর বললেন- “একটা সমস্যা হয়েছে, ৯/১০ সেপ্টেম্বর হবে না, ওটা ১১ই সেপ্টেম্বর করো আর বোম্বেতে হবেনা, ব্যাঙ্গালোরে ব্যবস্থা করো। শুনে বললাম- কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে তো এরকম স্টুডিও নেই, কি করব?’ উনি বললেন- “ চিন্তার কারণ নেই। ব্যাঙ্গালোরে DECCAN STUDIO আছে, খুব ভালো ব্যাবস্থা, আমি বলে দিচ্ছি। “অগত্যা গেলাম ব্যাঙ্গালোর। তখন ব্যাঙ্গালোর যেতে চার ঘন্টা লাগতো, ডিরেক্ট ফ্লাইট ছিল না। উঠলাম হোটেলে।
পরদিন স্টুডিওতে গেলাম। ওটা অডিও স্টুডিও, Asia’s biggest Audio Studio but no Video। স্টুডিওর মালিক Mr.Tangail- খুব প্রভাবশালী মানুষ ! সব শুনে Mr Tangail বললেন আমার তো অডিও ষ্টুডিও, ভিডিও না! তবে আমি এখানে দূরদর্শন এ কথা বলে ক্যামেরার ব্যাবস্থা করতে পারি, যদি কালার ক্যামেরা পাওয়া যায়! ওঁর ছেলের সঙ্গে গেলাম ব্যাঙ্গালোর দূরদর্শনে। কলকাতার মতোই অবস্থা- সব PROTAPAK ক্যামেরা। ফিরে এসে বলাতে ইনি বললেন- ‘কোনো চিন্তা নেই- ম্যাড্রাস থেকে যোগাড় করে দিচ্ছি।‘ বসে রইলাম হোটেলে। ওঁর ছেলে বাই রোড ম্যাড্রাস গেলেন। একদিন বাদে ফিরে জানা গেল –ওখানেও কিছু নেই। সব কথা জানিয়ে ফোন করলাম পন্ডিত রবিশঙ্করকে। শুনে বললেন- ‘তাহলে আর কিছু করার নেই, তুমি এটা ডিসেম্বরে করো- এবারে হবে না।‘ আমি শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। পন্ডিতজীকে বললাম- আমি এখান থেকেই বোম্বে ফ্লাই করছি, ১১ই সেপ্টেম্বরেই শুটিং করব। কলকাতায় ফিরে আপনার সাথে যোগাযোগ করছি। আবার বোম্বে- আবার WOAC – কথাবার্তা হলো। ক্যামেরা, টেকনিশিয়ান সব ব্যাবস্থা হল- নেহেরু গোল্ড কাপের মতোই, খরচ বেশীই হবে।
নির্ধারিত দিনে কলকাতা থেকে গিন্নি পপাই আর ১১ মাসের ছেলে নীলকে নিয়ে রওনা হলাম। আমার এক সিনিয়ার দাদা কাম বন্ধু প্রলয় চ্যাটার্জী তখন কলকাতায় ডালমিয়া কোম্পানীর সিনিয়ার রিজিওনাল ম্যানেজার। ওঁর স্ত্রী গীতা বৌদি রবিশঙ্করের অসম্ভব ফ্যান। ওঁরা বললেন- ওঁরাও যাবেন। গেলাম- গিয়ে উঠলাম চালুক্য হোটেলে। টেকনিশিয়ানরাও উঠলো। শুধু Rui Jaiswal কে রাখতে হল ফাইভ স্টার হোটেল তাজ রিজেন্সীতে। রবিশঙ্করজী উঠেছিলেন ওঁর এক ছাত্রীর বাড়িতে। শুধু অনুষ্ঠানের জন্য ওঁকে একদিন রাখতে হল তাজ রিজেন্সীতে।…… ফাইনাল কাউন্টডাউন শুরু হল। আমি হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইলাম জেনারেটর আছে কি না। Mr. Tangail প্রবল আত্মবিশ্বাসে বললেন- ‘ জেনেরেটরের প্রয়োজন নেই- এখানে লোডশেডিং হয় না।‘ ১১ তারিখ সকালে দেখি ব্যাঙ্গালোর শহরে পন্ডিতজীকে স্বাগত জানিয়ে তোরণ বসানো হয়েছে। Mr. Tangail-ই ব্যবস্থা করেছিলেন। আর ওখানকার সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে, “DECCAN STUDIO welcomes Pandit Ravi Shankar”. এ তো নিজেদের স্টুডিওর পাবলিসিটি। খুব বিরক্ত হলাম। ফোনে দুবেজীকে সব জানিয়ে স্টুডিওতে পৌঁছলাম। গিয়ে বললাম- ‘ আমার অনুমতি ছাড়া কেউ প্রেসের সঙ্গে কথা বলবে না। তাহলে আমি আজ অনুষ্ঠানই করবো না।“ আগেই বলেছি, ঠিক করেছিলাম সকালে তিনটি আধ ঘন্টার অনুষ্ঠান করব। তারপর লাঞ্চব্রেক। সন্ধ্যে বেলায় একটা এক ঘন্টার অনুষ্ঠান শুট করব। তখন কর্ণাটকের রাজ্যপাল শ্রী এন ব্যানার্জী and cream of the Bangalore residents were invited for that one hour programme! আরেকটা জরুরী তথ্য – এরকম একটা ক্লাসিক্যাল মিউজিকের প্রোগ্রামে এডিটিং ঠিকভাবে করার জন্য আমি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম Films Division -এর Chief Music Director Vijay Raghav Rao কে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে পণ্ডিতজি , অনিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় (তবলা) , আর সবাইকে নিয়ে মহড়ায় বসলেন! সাজ সাজ রব!! প্রেসেএ ভর্তি! অনুষ্ঠান শুরু হবে হবে , হটাৎ লোডশেডিং! Mr . Tangail কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার! উনি বললেন, এক্ষুনি এসে যাবে, চিন্তা করবেন না ! কোথায় কারেন্ট! ১০ টার সময়ে শুরু করার কথা ছিল……১০, ১১, ১২ , ১ টা…..কোথায় কারেন্ট! বাধ্য হয়ে ১.৩০ টার সময়ে লাঞ্চ ব্রেক দিতে হলো ! সকালে কিছুই রেকর্ডিং হলো না! মাথায় হাত…..কি করবো !!!….
কিছুই সেইরকম খাওয়া হলো না আমার, চিন্তায়! সকালে কোনো কাজ ই হলো না ! আর হাতে মাত্র একটা সন্ধ্যা ! Bangalore এ ওই একদিনের খরচ প্রায় ১,৮৬,০০০/- টাকা !! আবার কি ক্ষতির সম্মুখীন! সন্ধ্যাবেলা লোকজন আসা শুরু হলো !! পণ্ডিতজি এসে গেছেন….আমাকে ডেকে বললেন “প্রবীর, এখন তো আর তোমার আগের schedule মতো করতে পারবে না !! Either you take 3 nos ৩০ minutes programme or 1 no one hour programme !! ” আমি বললাম আমি ৩ টি ৩০ মিনিটস প্রোগ্র্যাম করবো….তাহলে অন্তত একটা সিরিজ হবে !! উনি বললেন ঠিক আছে !!
সব গেস্ট এসে গেছেন !! Governor ও এসে গেছেন! আমার রেকর্ডিং শুরু হলো !! অনুষ্ঠান চলছে। মিনিট ১০ হওয়ার পর দেখলাম, মনিটর এর স্ক্রিন কাঁপছে…….লাইনস পাস করে যাচ্ছে! এই রকম করতে করতে হটাৎ সব ব্ল্যাক !! হঠাৎ দেখি- স্ক্রীন কাঁপছে। রুইকে (Chief Camera operator) জিজ্ঞাসা করলাম –কি ব্যাপার? শেষে কাঁপতে কাঁপতে স্ক্রীন একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। পন্ডিতজী তখন মেজাজে একটা ধূন বাজিয়ে চলেছেন। আমার মাথায় বজ্রাঘাত। কি ব্যাপার! জানা গেল ভোল্টেজ সাংঘাতিকভাবে ড্রপ করেছে। ২২০ ভোল্টেজ লাগবে- ড্রপ করে হয়ে গেছে ১০৩। অনেক কষ্ট করে বুস্টার দিয়ে সেটাকে ১৬০ পর্যন্ত নেওয়া গেছে কিন্তু তাতে ক্যামেরা চলবে না। দুবেজীকে জানালাম। দুবেজী বললেন- “ আমি পন্ডিতজীকে বলছি, অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হোক। “Mr. Tangaiil তীব্র আপত্তি জানালেন- “ না… না… এতো গেস্ট আছেন, অনুষ্ঠান চলুক।“ দূবেজী বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, “পন্ডিতজী এখানে গেস্টদের জন্যে বাজাতে আসেন নি। উনি এসেছেন 24 Frames-এর জন্যে শুটিং করতে। “শেষে আমিও অনুরোধ করলাম যাতে উনি ওনার প্রোগ্রাম নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারেন। উনি কিন্তু মঞ্চে বসেই বুঝতে পেরেছিলেন যে ক্যামেরা চলছে না। কিন্তু বাজনা থামাননি। ওনাকে সব বললাম ! ক্ষিপ্ত রবিশঙ্কর ডেকে পাঠালেন Mr. Tangai কে। বললেন- “আপনি বললেন এখানে জেনেরেটরের প্রয়োজন নেই……তা ছাড়া এখানকার স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান না কি আপনার বন্ধু !! আমিই আপনার স্টুডিওর কথা বলেছি… আমি দিল্লি থেকে, টেকনিশিয়ানরা বোম্বে থেকে, প্রবীর কলকাতা থেকে এসেছে- আর আপনাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের এতো অভাব? আমি তো একটা প্রেস স্টেটমেন্ট দেব ভাবছি…..” ভয় পেয়ে গেলেন Mr. Tangai। বললেন আমাকে একটু টাইম দিন…আমি ব্যাবস্থা করছি…..আর ব্যাবস্থা !! আমি তো পায়চারি করে যাচ্ছি লবি তে…..নীল তো সোফা তে ঘুমিয়ে পড়েছে….পপাই আর গীতাবৌদি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে !! আমি একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি !! কি মারাত্মক টেনশন …এক রাতে ১, ৮৬,০০০/- !! ভাবতে পারছি না কিছু !!
সেই সময়ে রুই আমার কাছে এসে বললো…”Prabir , you have no luck …..আমি নেহেরু কাপের সময়ে দেখেছি !! তুমি এক কাজ কারো, পণ্ডিতজির কাছে ওয়ান day or night নাও !! আমরা বোম্বে তে আমাদের ষ্টুডিও তে করে দেব !!” আমি বললাম, আবার তো খরচ !! রুই বললো, Western outdoor will not charge a single paisa from you…..It’s my commitment” …..তুমি শুধু পণ্ডিতজির ডেট নাও !! কিন্তু পণ্ডিতজি বললেন , আমি কাল দিল্লী ফিরবো, তাপস সেন আসবেন, ওনার সঙ্গে মিটিং আছে…পরের দিন লন্ডন via মুম্বাই !! আমার একদম সময়ে নেই !! ” অবশেষে কারেন্ট এলো, সব phase change করে !! তখন প্রায় রাত ১০ টা !! শুরু হলো রেকর্ডিং !! যখন শেষ হলো,তখন ঘড়ির কাটা রাত ২ টোয়ে ছুঁই ছুঁই !! পণ্ডিতজির আঙ্গুল থেকে রক্ত ঝরছে !! উনি বললেন হ্যাপি ?? আমি বললাম হা কিন্তু ওই এক ঘন্টা অনুষ্ঠান টা করতে পারলে ভালো হতো !! তখন পণ্ডিতজি যা বললেন, আমার কানে এখনো সেটা ভাসে…I hope, you don’t want me to collapse at this age” অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শুটিং শেষ হল। এবারে স্পনসর খোঁজার পালা। গেলাম বোম্বে। দেখা করলাম Nestle Company Vice President (Marketing) Mr. Sachdeva-র সাথে, সব বললাম। ওঁর প্রতিক্রিয়াটা বেশ মনে আছে …… “Ravi Shankar !! Its OK. But we want HUMLOG “ হমলোগ তখন ন্যাশনাল দূরদর্শনে জনপ্রিয় ধারাবাহিক। Nestle তার স্পনসর। শেষে কলকাতায় ফিরে খোঁজ করতে করতে গেলাম #বিজলী_গ্রীল –এর মালিক দেবু বারিকের কাছে। উনি রাজী হলেন কিন্তু একটা অসুবিধের কথা জানালেন। বললেন, বিজলী গ্রীলের বিজ্ঞাপনের কোনো ফিল্ম নেই- সেটা শুট করতে হবে। আমি রাজী। উনি দুটো শর্ত দিলেন- এক, স্ক্রিপ্ট লিখবেন সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত। দুই, ;পরিচালনা করবেন গৌতম ঘোষ। আমি তাতেও রাজী। গড়িয়াহাটের মেঘমল্লারে গিয়ে দিব্যেন্দু পালিতের সঙ্গে দেখা করলাম। গৌতমকে আমি আগে থেকেই খুব ভালো করে চিনতাম ও ভালো পরিচয়ও ছিল !!
সব ব্যবস্থা হল- দিব্যেন্দুদার বাড়িতেই বাচ্চাদের নিয়ে বিজলী গ্রীলের বিজ্ঞাপন শুট করা হল। আবার এডিটিং করতে বোম্বে যেতে হলো। গৌতম তখন “পার” ছবির প্রিন্ট করাতে ম্যাড্রাস গিয়েছিল। এখান থেকে ও বোম্বে চলে এল। সব প্রোগ্রাম তৈরি করে দেখা করলাম কলকাতা দুরদর্শনের তৎকালীন স্টেশন ডিরেক্টর নির্মল শিকদারের সঙ্গে। উনি সব দেখে, বুঝে নিলেন। তখনও কলকাতার অ্যাপ্রুভাল দেবার রাইট নেই। অ্যাপ্রুভালের জন্য পাঠানো হলো দিল্লীতে। ওখানে তখন DDG Mr. Sashikant Kapoor. রোজ কলকাতা থেকে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, দিল্লী থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই !! তখন কলকাতা দূরদর্শনের স্পন্সরড প্রোগ্র্যাম প্রোডিউসার ছিলেন সলিল দাসগুপ্ত !! ডেপুটি ডিরেক্টর শিপ্রা রায় !! এই দুজনের কেউই আজ আর নেই !! আমি রোজ সকল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দূরদর্শন এ পরে থাকতাম !! সলিল দা আমাকে খুব পছন্দ করতেন !! ওনার ঘরে বসে চা খেতাম আর ঘন ঘন টেলেক্স রুম এ খবর নেওয়া হতো কোনো টেলেক্স এসেছে কি না !! একদিন সন্ধ্যার মুখে উঠবো উঠবো করছি, হটাৎ একজন স্টাফ এসে সলিল দা কে বললেন, স্যার, মনে হচ্ছে টেলেক্স রুম এ একটা টেলেক্স এসে পরে আছে…..সঙ্গে সঙ্গে ঘর খুলে ভেতরে গিয়ে দেখা গেলো, আমার programme এর গ্রীন সিগন্যাল এসে গেছে । আমি তো আনন্দে আটখান … স্টেশন ডিরেক্টর নির্মল শিকদার বললেন , “চলুন শিপ্রাদির ঘরে। একসঙ্গে সবাই কফি খাব।“ শিপ্রা রায় তখন ডেপুটি স্টেশন ডিরেক্টর। খুব মজা পেয়েছিলাম টেলেক্সের উপর স্টেশন ডিরেক্টরের নোটস দেখে… “Ultimately the battle has won “……..
১৯শে এপ্রিল ১৯৮৫- রাত ৮.০৫- বিজলী গ্রীলের স্পনসরশীপে কলকাতা দূরদর্শনে পন্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে অনুষ্ঠান “Ravishankar – A legend of Glory, Part 1” সম্প্রচারিত হল…….
১৯.০৪.১৯৮৫, ২৬.০৪.১৯৮৫ এবং ০৩.০৫.১৯৮৫, রাত ০৮.০৫ মিনিট এ! সলিল দা ইন্টারভিউ তে ভুল করে ২টি পর্ব বলেছেন ! দূরদর্শন এ প্রথম স্পন্সরড সিরিয়েল!! এটা ছিল নন ফিক্শন …প্রথম ফিক্শন সিরিয়েল গৌতম ঘোষ এর “বাংলা গল্প বিচিত্রা” Sponsored by Dey’s Medical!
আরেকটা ভেঞ্চার শেষ হলো। এবারে কি করা যায় !!!!!!
..
Be First to Comment